আফগানরা যোদ্ধার জাত। যুদ্ধে তারা হার মানতে জানেনা। জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করে শেষটা দেখে ছাড়ে আফগানরা। যেমনটি করে দেখাল এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। মাত্র ২০১০ সাল থেকে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফিরেছে আফগানরা। আর মাত্র ১৪ বছর না যেতেই ইতিহাস গড়ল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়ে। এ যেন আফগান রূপকথা। যে রূপকথার স্বপ্ন আফগানরা দেখে আসছিল সেই ১৪ বছর আগে থেকে। অস্ত্র হাতে আফগান যোদ্ধারা যেভাবে দেশকে মুক্ত করেছে তেমনি বিশ্বকাপে রশিদ–নবী–নাবিনদের এক একটা বল যেন এক একটা মরনাস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে ক্রিকেট মাঠে। আর তাতেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তারা আজ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। কথায় আছেনা ভাগ্যও সাহসীদের পক্ষে কথা বলে। আফগান ক্রিকেটারদের সাহসী ভুমিকার কারণেই আজ তারা বিশ্বের সেরা চার দলে। অপরদিকে এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষটা রাঙানো হলোনা বাংলাদেশের। টাইগারদের হারিয়ে আফগানিস্তান রচনা করেছে নতুন এক ইতিহাস। ইতিহাসটা এই কারণেই যে, অস্ট্রেলিয়া–নিউজিল্যান্ডের মত দলকে হারিয়ে তারা বিশ্বকাপের শেষ চারে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকালে সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নল্ড ভেলে গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান যখন মুখোমুখি হচ্ছিল তখন মাঠের বাইরে নিশ্চয়ই প্রার্থনায় বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। কারণ তাদের সেমিফাইনালে যাওয়াটা যে ঝুলছিল এই ম্যাচের ফলের উপর। ম্যাচে আফগানিস্তান হারলেই অসিদের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হতো। কিন্তু সেটা হতে দেননি রশিদ খান–নাবিন উল হকরা। বাংলাদেশকে ডিএলএস মেথডে ৮ রানে পরাজিত করে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিল আফগানিস্তান। বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করল আফগানরা। আরো একবার বাংলাদেশ হারল ব্যাটারদের চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় । বোলাররা দারুণভাবে তাদের কাজটা সম্পন্ন করলেও ব্যাটাররা পারেনি তাদের কাজটা করতে। যেটা বাংলাদেশের ব্যাটাররা পারেনি পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই। বোলাররা জয়ের মত মঞ্চ তৈরি করে দিলেও সে মঞ্চটা ভেঙ্গে দিয়েছে ব্যাটাররা। তানজিদ তামিম, শান্ত, সাকিব, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ কেউই নিতে পারেনি দায়িত্ব। দায়িত্বহীনতার ফল যা হওয়ার ঠিক তাই হয়েছে। বাগে পেয়েও আফগানিস্তানকে হারানো গেলনা। আর শেষ ম্যাচটাও রাঙানো হলোনা। সুপার এইট পর্বের একটি ম্যাচও না জিতে বাংলাদেশকে ফিরতে হচ্ছে গ্রুপ পর্বের তিন জয় নিয়ে। পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা লজ্জার ছাপ রেখে দিল। এমন ম্যাচেও যখন হারে বাংলাদেশ তখন আশাহত হওয়া ছাড়া নিশ্চয়ই কিছু থাকেনা দেশের ক্রিকেট প্রমীদের। আরো একটি হাতাশার বিশ্বকাপ শেষ করে ফিরছে বিড়ালে পরিনত হওয়া টাইগাররা। আর আফগান যোদ্ধারা নিজেদের জাত চিনিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। যেখানে তারা মুখোমুখি হবে দক্ষিন আফ্রিকার। এখন আফগানিস্তান ফাইনালে খেলে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। আফগান যোদ্ধারা দেখিয়ে দিল মাঠে লড়াইটা কিভাবে করতে হয়। যে লড়াই জিতে তারা সত্যিই এখন বীর।
টসে জিতে ব্যাট করতে নামা আফগানিস্তানের দুই ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ এবং ইব্রাহিম জাদরান দারুণ শুরু করেন। রানের গতি কিছুটা কম হলেও ৫৯ রানের জুটি গড়েন দুজন। ২৯ বলে ১৮ রান করা ইব্রাহিম জাদরানকে ফিরিয়ে এজুটি ভাঙ্গেন রিশাদ হোসেন। দ্বিতীয় উইকেটে আজমত উল্লাহকে নিয়ে ২৫ রান যোগ করেন গুরবাজ। মোস্তাফিজ ভাঙ্গেন এজুটি। তার শিকার ১০ রান করা আজমতউল্লাহ। চার রান পর নিজের দ্বিতীয় শিকার বানিয়ে ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজকে ফেরান রিশাদ হোসেন। ৫৫ বলে ৪৩ রানের ইনিংসে ৩টি চার এবং একটি ছক্কা মারেন গুরবাজ। এরপর আফগানদের আর দাঁড়াতে দেয়নি বাংলাদেশের বোলাররা। শেষ দিকে রশিদ খানের ১০ বলে ১৯ রানের সুবাদে ১১৫ রান সংগ্রহ করে আফগানিস্তান। তিনটি ছক্কা মেরেছেন রশিদ খান। বাংলাদেশের পক্ষে ২৬ রানে ৩টি উইকেট নিয়েছেন রিশাদ হোসেন।
১১৬ রানের লক্ষ্যে যখন ব্যাট করতে নামার অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ তখন শুরু হয় বৃষ্টি। তবে খেলা শুরু হতে বেশি দেরি হয়নি। শুরুটা দারুণ করেছিলেন লিটন দাশ। কিন্তু তানজিদ তামিম যথারীতি ব্যর্থ। রানের খাতা খোলার আগেই ফজল হক ফারুকির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরলেন তামিম। অধিনায়ক শান্তু পারলেননা ব্যর্থতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে। নাবিন উল হককে অযথা উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানার কাছে মোহাম্মদ নবীর হাতে ক্যাচ দিলেন ৫ রান করা শান্ত। তবে পরের ধাক্কাটা অনেক বড় বাংলাদেশের জন্য। প্রথম বলেই গোল্ডেন ডাক মেরে ফিরলেন সাকিব নাবীন উল হককে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। ১২.১ ওভারে ১১৬ রান করতে পারলেই সেমিফাইনালে যেতো বাংলাদেশ। শুরুর দিকে বাংলাদেশ দল সে চিন্তা নিয়েই মাঠে নেমেছিল । কিন্তু তিন উইকেট পতনের পর সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনে টাইগাররা। আর তাতেই সব হারায় বাংলাদেশ। ৩.২ ওভারে বাংলাদেশের রান যখন ৩ উইকেটে ২৯ তখন আবার শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার পর আবার খেলা শুরু হলে বাংলাদেশের সামনে নতুন লক্ষ্য দাড়ায় ১৯ ওভারে ১১৪ রান। আর সে লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে বৃষ্টির মতই উইকেট পড়েছে বাংলাদেশের। এই যেমন পুরো টুর্নামেন্টে ব্যর্থ সৌম্য শেষ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেননা । রশিদ খানের বলে বোল্ড হয়ে ফিরলেন ১০ রান করে। তবে একপ্রান্ত ধরে রেখে লড়াই করছিলেন লিটন দাশ। পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সফল ব্যাটার তাওহিদ হৃদয় একটু বেশি তাড়াহুড়া করলেন। বেশি আগ্রাসী হতে গিয়ে রশিদ খানের বলে ফিরলেন ৯ বলে ১৪ রান করে। ৬৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বেশ চাপে বাংলাদেশ। সে চাপ আরো বাড়িয়ে দিলেন অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ। রশিদ খানের বলে ফিরলেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে। রিভিও নিয়ে তাকে ফেরান রশিদ। পরের বলে বোল্ড হয়ে ফিরেন রিশাদ হোসেন। বাংলাদেশ তখন খাদের কিনারায় । একপ্রান্ত আগলে রাখা লিটন দাশ ৪১ বলে তুলে নেন নিজের ক্যারিয়ারের ১১ তম টি–টোয়েন্টি হাফ সেঞ্চুরি। কিন্তু দলকে আরো বিপদে ঠেলে দিয়ে ফিরলেন তানজিম সাকিব এবং তাসকিন। তখনো বাংলাদেশের দরকার ৮ বলে ৯ রান। তখনো উইকেটে ভরসার নাম লিটন দাশ। কোনমতে দুটি বা একটি বল মোকাবেলা করতে পারলেই হতো মোস্তাফিজের। পরের ওভারে লিটন পেতেন স্ট্রাইক। কিন্তু মোস্তাফিজ পারলেননা একটি বলও মোকাবেলা করতে। নাবিন উল হকের পরের বলে মোস্তাফিজুর রহমান এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরলে উল্লাসে ফেটে পড়ে আফগান ক্রিকেটাররা।
কারণ বাংলাদেশের ৮ রানের পরাজয়ে আফগানরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়ে। লিটন দাশ অপরাজিত ছিলেন ৪৯ বলে ৫৪ রান করে। আফগানিস্তানের রশিদ খান ২৩ রানে এবং নবীন উল হক ২৪ রানে নিয়েছেন ৪টি করে উইকেট। সেমিফাইনালে জায়গা করে নেওয়া আফগান রূপকথা কবে থামবে সেটা সময়ই বলে দেবে।