পান : চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ২৫ জুন, ২০২৪ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের বাঙালিদের চায়ের অভ্যাসের মত পান খাওয়ার অভ্যাস সেই সুদীর্ঘকাল থেকেই। বিয়ে জন্মদিন, মেজবানসহ নানা উৎসবের খাওয়া শেষে পান দিয়ে আপ্যায়ন একটি চিরায়ত ঐতিহ্য। আমাদের গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে একসময় দেখা যেতো মাখালা, দাদাদাদি, নানানানিদের বিছানার পাশে পান খাওয়ার নানা উপকরণসহ একটি পানের বাটা। সেই পানের বাটার ওপরে রাখা হতো সুপারি কাটার একটা বিশেষ যন্ত্র। চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘ছোরতা’ বলা হয়। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তাকে প্রথমেই পান দিয়ে আপ্যায়ন করার একটি স্বতঃসিদ্ধ রীতি প্রচলিত ছিলো। এখনো গ্রাম বাংলার অনেক মহিলার শাড়ির গোছায় পান বাঁধা থাকে। পথে ঘাটে কিংবা গাড়িতে অনেকের সাথে পান এখনো একটি অপররিহার্য সঙ্গী। পানের সাথে নানা ধরনের বাহারি জর্দার মিশেল দেয়া হতো। সময়ের পরিবর্তনে পান খাওয়ার রীতি বৈচিত্র্য অনেকটাই পাল্টেছে, কিন্তু পানের জনপ্রিয়তা ম্লান হয়নি৷ পান আমাদের অর্থনীতির একটি অন্যতম উৎপাদনশীল খাত। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ার আধিবাসীরা পান খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেন হাজার বছর আগে থেকেই। পান লতাজাতীয় এক ধরনের গাছের পাতা। ইতিহাস থেকে জানা যায় আর্য ও আরবরা একে তাম্বুল নামে ডেকেছে। পান চাষের নিয়ম থেকে জানা যায় সাধারণত গাছের ওপর থেকে নাকি ১৬টি পান রেখে নিচের পানগুলো তোলেন চাষিরা। পানের কিছু ভেষজ গুণ রয়েছে। যেমন পানের রস হজমে সহায়তা করে, পেট পরিষ্কার রাখে। অনেকের দাবি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও এর ভূমিকা আছে। তবে পানের সঙ্গে অতিরিক্ত তামাক, চুন, খয়ের ও সুপারি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। ভাত বা অন্যান্য আপ্যায়ন শেষে পান বিলি করার সংস্কৃতি এই বাঙালির সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সুদীর্ঘকাল থেকেই ভারতবর্ষের রাজা, সম্রাটদের অন্দরমহলেও পান খাওয়ার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা স্ত্রী নূরজাহানেরও পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং তিনি তা অন্দরমহলের অন্যান্যদের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। এই অন্দরমহলে পান খাওয়ার সংস্কৃতিটা বাঙালিদের জন্য যেন চিরকালীনই হয়ে গেছে। আমাদের বাংলাদেশে বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজালী, মহানলী, চেরফুলী, ভাবনা, সন্তোষী, জাইলো, ভাওলা, ঝালি, প্রভৃতি জাতের পানের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু পান খাওয়ার এ সংস্কৃতি শুধু চট্টগ্রামেই নয়, সারা দেশে এ সংস্কৃতি বিদ্যমান। ধূমপানের মত পান খাওয়াকে কেউ নেতিবাচকভাবে নেন না। চায়ের মতই অতিথি আপ্যায়নে এটি অতি সাধারণ একটি অনুষঙ্গ। আমাদের চট্টগ্রামে মহেশখালীর পান একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের এই দ্বীপাঞ্চলের পান স্বাদে অনন্য। মহেশখালীর মিষ্টি পান নিয়ে শিল্পী ও গীতিকার সনজিত আচার্যের জনপ্রিয় আঞ্চলিক একটি গান আছে এবং চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তা বেশ সমাদৃত। ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম মইশখাইল্যা পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’অসাধারণ এই জনপ্রিয় গানটি এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। শুধু চট্টগ্রামের নয়, প্রমিত বাংলা গানেও পানের ব্যবহার হয়েছে চমকপ্রদভাবে। কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইলো না’ গানটির কথা কে না জানে ? চট্টগ্রামের মাটি কিছু কিছু পণ্য উৎপাদনের উপযোগী। যেমন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর চা বাগান রয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের বাইরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতেও প্রচুর চা উৎপাদিত হয়। তেমনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পান উৎপাদিত হলেও চট্টগ্রামের পানের একটি আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মহেশখালী দ্বীপের নাম উল্লেখযোগ্য। এজন্যই শিল্পী ও গীতিকার সনজিত আচার্য তাঁর লেখা গানে মহেশখালীর পানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। এখানকার মাটি পান চাষের জন্য বেশ উপযোগী এবং এ পানের মিষ্টতার খ্যাতি দেশ জুড়ে। এখানকার অধিবাসীদের অন্যতম সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পেশা পান চাষ। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এর ভূমি পান চাষের জন্য অনুকূল। একসময় মহেশখালীর মিষ্টি পান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। অধিকন্তু, এখানকার পানের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপআমেরিকাতেও ছড়িয়ে রয়েছে। কারও কারও মতে আফ্রিকা মহাদেশের কিছু কিছু দেশেও এর সুনাম রয়েছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে জানা যায় সমগ্র বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ মিষ্টি পান মহেশখালী দ্বীপে উৎপাদিত হয়ে থাকে। পান অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ফসল। সাধারণত বরজ তৈরি করে পানের চাষ করতে হয়। আবহাওয়া, মাটি, জাত, চাষাবাদ পদ্ধতি ইত্যাদির কারণে স্থানভেদে পানের ফলন কমবেশি হয়। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মহেশখালী দ্বীপ আবহাওয়া, মাটি, জাত, চাষাবাদ পদ্ধতিতে পান চাষ অনেক এগিয়ে। পান চাষের জন্য বিশেষ দক্ষতা ও দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। মহেশখালী দ্বীপের পান চাষিদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এ অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত হয়। চুন, সুপারি, মশলা দিয়ে মহেশখালীর পান মুখে পুরে দিতেই মিষ্টিতে ভরে যায় পুরো মুখ। আকারে বড় এবং মিষ্টি স্বাদের কারণেই দেশবিদেশে খ্যাতি পেয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মহেশখালীর এই পান। দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবসহ সামাজিক রীতি, বিয়েশাদিতে এই মিষ্টি পানের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কঙবাজার, চট্টগ্রাম ছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ঢাকায় মহেশখালীর পান সরবরাহ হয়। সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি হয় মহেশখালীর মিষ্টি পান। কিন্তু তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য নয়। পান ক্ষেতকে বলা হয় পানের বরজ। পান চাষের জন্য উপকরণ শন, উল, বাঁশ, কীটনাশক, সার, খৈল ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। এসব উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পান চাষ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। অনেক চাষিরা জীবিকার তাগিদে এখনো মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হন। ফলে লাভের বড় অংশটি চলে যায় মহাজনের ঘরে। পান দেশের অন্যতম একটি কৃষিজ উৎপাদশীল খাত। এই পান চাষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়ে উঠতে পারে দেশের আয়ের অন্যতম উৎস। দেশের কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিভাগ বা কৃষি সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। কৃষিজ পণ্য হিসাবে প্রচার প্রচারণায় পিছিয়ে থাকা এ পণ্যকে সামনে নিয়ে আসা জরুরি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও খুলে যেতে পারে এর অবারিত বাাজার। চাষিরা সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিজেরাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পানের কথাও এখানে বলা যায়। মহেশখালীর পান বেশ মিষ্টি। আর হাটহাজারীর পান ঝাল। আকারে কিছুটা বড়। উত্তর চট্টগ্রামসহ বিশেষ করে খাগড়াছড়িসহ তিন পাহাড়ি জেলায় হাটহাজারীর পানের কদর সবচেয়ে বেশি। হাটহাজারীর পানের কদর আছে ফেনী, নোয়াখালী ও মীরসরাই এলাকাতেও। পান চাষের প্রধান ঝুঁকি অতি বৃষ্টি। সেপ্টেম্বরের শেষের বর্ষা অর্থাৎ পানচাষ মৌসুমের শুরুতে বর্ষা দেখা দিলে অনেক বরজ নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টির মাত্রা অধিক হলে চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ে। চাষিদের প্রশিক্ষণ, সহজ কিস্তিতে ঋণপ্রদান করলে পানচাষ হবে আরো সমৃদ্ধ এবং চট্টগ্রামের এ অঞ্চল পান উৎপাদনে দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখে রপ্তানিমুখী কৃষি পণ্য হিসাবে অর্থনীতিতেও রাখতে পারে বিশাল অবদান।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ; প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশবের স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধট্যানারি শিল্প বিকাশে বাধা কোথায়