দ্বিতীয় দফাতেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলবে হাজির হননি পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ। তবে দুদিন আগে তার ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা পাঠিয়েছেন। প্রথম দফা সময় বাড়ানোর পর গতকাল রোববার দুদকে হাজির হওয়ার কথা ছিল বেনজীরের। একই অভিযোগে আজ সোমবার হাজির হতে বলা হয়েছে তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে।
বেনজীরের না আসার বিষয়ে আইন ও বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। তবে সচিব বলেছেন, সশরীরে হাজির না হলেও শুক্রবার আইনজীবীর মাধ্যমে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর তার বক্তব্য পাঠিয়েছেন। হাজির হওয়ার সঙ্গে সেই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা নেই বলেও জানান তিনি। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল ব্রিফিংয়ে খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, সেই বক্তব্য তারিখ বর্ধিতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেখানে (বক্তব্যে) তার ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রথমে গত ৬ জুন দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছিল। ওই সময় তার বিদেশ চলে যাওয়ার গুঞ্জনের মধ্যে ৫ জুন তার পক্ষে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। এরপর সময় বাড়িয়ে ২৩ জুন তাকে হাজির হতে বলে দুদক। একইভাবে বেনজীরের স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই কন্যা ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে গত ৯ জুন দুদকে হাজির হতে বলা হয়। পরে তারাও সময় চেয়ে আবেদন করেন। বেনজীরের হাজির হওয়ার তারিখের পরদিন, অর্থাৎ ২৪ জুন স্ত্রী–সন্তানদের জন্য তারিখ রাখে দুদক।
দুদক আইন অনুযায়ী কাউকে নোটিস করলে তিনি আসতে বাধ্য কিনা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। তবে তারা সময় চাইতে পারেন। তখন কমিশন ১৫ দিন সময় দিতে পারে। দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক গত ৫ জুন বেনজীরের সময় আবেদন পাওয়ার পর বলেছিলেন, সময় দেওয়ার পরও যদি তিনি দুদকে না আসেন তাহলে ধরে নিতে হবে তার কোনো বক্তব্য নেই। তখন নথিপত্র দেখে যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় হবে, না হলে নয়।
বেনজীর ও তার স্ত্রী–কন্যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে বোট ক্লাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের জন্য দেওয়া চিঠিতে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে থাকার কথা বলেন। তারা সবাই দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ করেননি সাবেক আইজিপি।
বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ প্রধান, যিনি একাধারে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট র্যাবেরও প্রধান ছিলেন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান। গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে তাকে নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকায়। সেখানে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে আসে। এরপর আলোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ–৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এপ্রিলের শেষে বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন করেন। এরপর ২২ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, বেনজীরের ‘অবৈধ সম্পদ’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। এজন্য তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিন এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে বেনজীরের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন চেয়ে নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী এবাদাত হোসেনের বেঞ্চ।
নির্দেশনার পর সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আটটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক। পরে দুদকের আবেদনে বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। সেই সঙ্গে তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ারও অবরুদ্ধ করার আদেশ আসে। সেই অনুযায়ী পরে ব্যবস্থাও নেয় দুদক।
এখন কী করবে দুদক? : বিবিসি বাংলা জানায়, দ্বিতীয় দফা হাজির হওয়ার দিন গতকাল বেনজীর আহমেদ দুদকে উপস্থিত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে কী হবে সেটি নিয়ে অনেকের আগ্রহ রয়েছে। দুদক বলছে, সাবেক এই পুলিশ মহাপরিদর্শকের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। তার বিরুদ্ধে আরো অপরাধলব্ধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।
গতকাল সশরীরে হাজির না হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী তার ঠিকানায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানো হবে। এরপর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরও ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন তিনি।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, উনি আসুক না আসুক আমাদের অনুসন্ধান চলতে থাকবে। অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধানকারী দল কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর কমিশনের অনুমতিক্রমে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
এদিকে বেনজীরের সম্পত্তি নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের প্রমাণও পেয়েছে। এসব কারণে তিনি ও তার পরিবারের সম্পত্তি জব্দ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দেরও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। দুদক বলছে, এখনো সাবেক এই পুলিশ প্রধানের সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে তারা। গতকাল দুদকে হাজির না হওয়ায় পরবর্তী প্রক্রিয়ার কথা বললেও মামলার বিষয়ে কিছু বলেননি দুদকের আইনজীবী।
দুদক আইন অনুযায়ী, বেনজীর সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান সুযোগ রয়েছে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হতে পারে ‘নন–সাবমিশন’ মামলা, আর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের’ মামলা করারও সুযোগ রয়েছে। দুদক আইনে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন–সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলা করতে দুদকের কোনো গাফিলতি রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে সংস্থাটির আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলতে থাকবে। অনুসন্ধান শেষে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। এই রিপোর্ট দেখে কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। মামলার অনুমোদনের বিষয় কমিশনের হাতে।