পুরুষশাসিত সমাজে নারী প্রকৃত স্বাধীনতা কখনো ভোগ করেনি। পুরুষ যেটুকু অনুমোদন করেছে সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে নারীকে। কেরালার নাঙ্গেলি থেকে বর্তমানে ইরানের মাশা আমিনি এক একটি বিদ্রোহীর নাম, যারা অনমনীয় থেকে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন কিন্তু মনে নেননি পুরুষের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, অন্যায্যতাকে।
শরীরের কোনো অংশে অনাবৃত নারী দেখলে আমরা ধরে নিই তা কোনো আফ্রিকান দেশের বা বিশ্বের একেবারে অনুন্নত কোনো জাতিগোষ্ঠীর। ধরে নিই সেখানে তথাকথিত সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি। শুনলে অবাক লাগে মাত্র সোয়া দুইশ বছর আগেও এই উপমহাদেশে নারীদের বাঁচতে হতো শরীরের উপরি অংশকে অনাবৃত রেখে এবং সেটাও হয়েছিল উচ্চবর্ণ ও ধর্মীয় নেতাদের ইচ্ছায়।
১৮০৩ সালের কথা। কেরালার চেরথালা। সমুদ্রের পাশেই সাজানো গোছানো ছোট্ট একটা শহর। আজ থেকে প্রায় ২২০ বছর আগের কথা। সেসময় কেরালার রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর।
সেসময় নিম্নবর্ণের নারী–পুরুষকে নির্বিশেষে অলঙ্কার পরিধানের জন্য কর দিতে হত। পুরুষেরা গোঁফ রাখতে চাইলে কর দিতে হতো। এ সময় প্রচলিত ছিল তার চেয়েও জঘন্য একটি করব্যবস্থা। যাকে বলা হতো স্তন কর। স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘মূলাক্করম’। তখন নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু নারী তার স্তন ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধু ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হিন্দু নারীরা তাদের স্তন এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারতো, বাকি শ্রেণীর নারীদের প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো।
মূলত দক্ষিণ ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলারা গায়ে বিশেষ করে বুকের ওপর কোনো কাপড় পরিধান করতে পারতো না। তারা যদি বুকের ওপর কোনো কাপড় পরিধান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করতো, তাহলেই তাদের স্তন কর প্রদান করতে হতো। এমন একটি আইন বা নিয়ম ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতে চালু ছিল। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলারা বাধ্য হয়েই এই বর্ণভিত্তিক স্তন কর প্রদান করে থাকতো।
সব হিন্দু মহিলাদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে যারা উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণ শ্রেণীর মহিলা ছিল, তাদের এই কর বা ট্যাক্স দিতে হতো না এবং তারা বুকের ওপর কাপড় পরিধান করার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করতে পারতো। আর এই আইনের করাতলে শোষিত হতো নিম্নবর্ণের নারীরা।
সমাজের উঁচু শ্রেণীর কিছু ব্যক্তি ও তাদের সহযোগী বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু অংশের লোকেরাই এই আইন প্রয়োগ করে মূলত নিম্নবর্ণের মানুষকে শাসন ও শোষণ করতো।
আবার এই শুল্কের পরিমাণ নির্ভর করতো স্তনের আকারের ওপর। এই স্তন শুল্কের মোটা অংশ চলে যেত পদ্মনাভ মন্দিরে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড–এর তথ্য অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির।
এক কথায় বলা যায় জোর যার মুল্লুক তার। তবে এই আইন বেশিদিন টিকতে পারেনি। নিচু শ্রেণীর লোকদের সম্মিলিত প্রতিবাদে বাতিল হয়েছিল এই আইন। নিম্নবর্ণের এক মহিলাই সর্বপ্রথম এর প্রতিবাদ করেছিল।
১৮০৩ সালে নাঙ্গেলি নামের এক নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখেতো। যখন গ্রামের ট্যাঙ কালেক্টর তার থেকে স্তন কর চাইতে আসতো, তখন নালেঙ্গি তা দিতে অস্বীকার করত। প্রতিদিন শুল্ক সংগ্রাহকরা তার বাড়িতে এসে তাকে শুল্ক দেওয়ার জন্য চাপ দিতো। না দেওয়ায় দিনে দিনে বাড়তে লাগল করের বোঝাও।
একদিন শুল্ক কর্মকর্তারা এলে নালিঙ্গি নিজের দুটি স্তনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে পাতা দিয়ে মুড়িয়ে ট্যাক্স কালেকটরের হাতে তুলে দিলেন। তখন কাটা স্তন দেখে ট্যাক্স কালেকটর অবাক হয়ে যায়।
স্তন কেটে ফেলার ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোক সইতে না পেরে তার স্বামীও আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আলোড়ন সৃষ্টিকারী হৃদয়বিদারক এই ঘটনার পর থেকেই স্তন কর রোহিত হয়।
স্তন কর রোহিত হলেও দক্ষিণভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত করতে হয়েছে তাদের। যখন কিছু হিন্দু নারী তাদের শরীরের ওপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেয়, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের ওপরের অংশ আবৃত করা ধর্মবিরোধী। বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি আন্দোলন সংঘটিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো হিন্দু নারীদের শরীরের ওপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। এই আন্দোলন ‘কাপড়ের’ আন্দোলন (দাঙ্গা) হিসেবেও পরিচিত।
যুগে যুগে নারীরা শোষিত হয়ে আসছে। নারীদের অবদমন করে রাখবার জন্য নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। শোষণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেকে শেষ করে, শাসকদের রোষাণলে পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে অনেকে।
তাই তো নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নারীদেরকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলো নাঙ্গেলি। তাই নাঙ্গেলি একটি বিদ্রোহের নাম, একটি প্রেরণার নাম। এই পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে কখনো অনাবৃত করতে চেয়েছে, কখনো ঢেকে রাখতে চেয়েছে। নারীকে নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে দেয়নি কখনো।
ইরানের মাশা আমিনির ভূমিকাও এমন। ইরানের বেঁধে দেওয়া ধর্মীয় পোশাকের বিরোধিতা করে প্রাণ দিয়েছে মাশা আমিনি। সে যে এই যুগের আরেক নাঙ্গেলি।
মাশা আমিনির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় অবদমন ব্যবস্থার সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নারীরা চুল কাটছেন, চুল দিয়ে পতাকা বানিয়ে ওড়াচ্ছেন, হিজাব পোড়াচ্ছেন। বহু পুরুষও তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল নতুন প্রজন্ম, অন্যান্য দেশের নারীরও। নারীদের ভয় কেটে গেছে। এ রকম বাঁধ ভাঙা সাহসী দৃশ্যগুলো বিশ্বময় মানবিক অন্তরে সহানুভূতি, সহমর্মিতা জাগিয়ে তুলছে। বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসান ঘটাতে, নারীর নিজের ইচ্ছেয় বাঁচবার অধিকার আদায়ে।
অনেক মৃত্যুর পর, অনেক ত্যাগের পর একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন নারীরা নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে পারবে।