আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)

মো. বাদশাহ আলম | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে অসংখ্য আউলিয়া দরবেশ আগমন করেন। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দুল আউলিয়া, অলীকুল শিরোমণি, হযরত শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) ছিলেন বার আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত আনোয়ারা উপজেলার রোস্তম হাট সংলগ্ন বটতলী গ্রামে তাঁর মাজার শরীফ অবস্থিত।

হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও জনশ্রুতি, প্রচলিত প্রবাদ, গবেষণা লব্ধ জ্ঞান ও তথ্য থেকে তাঁর জীবনের অনেকদিক সম্পর্কে জানা যায়। তিনি সুদূর ইয়েমেনে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের পিতার কাছে ও পারিবারিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করে তাসাউফের শিক্ষা আয়ত্ত করেন। পরিণত বয়সে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সাধন ও কামেলিয়াত প্রাপ্ত হওয়ার পর তাঁর পরিবারসহ তাঁর মামা চট্টগ্রাম শহর আবাদকারী প্রখ্যাত পীরে কামেল হযরত শাহ সূফী সৈয়দ বদর শাহ্‌ (রহ.) এর সাথে দিল্লী আসেন। কিছু সময় দিল্লীতে অবস্থানের পর মামা ভাগিনা তৎকালীন রাজধানী গৌড় তথা শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু বাংলায় চলে আসেন।

জনশ্রুতিতে জানা যায়, হযরত বদর শাহ্‌ (রহ.) এবং হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামের ৮ মাইল পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের তীরে ইছাখালী গ্রামের কড়ির হাট বন্দরে অবতরণ করেন। কথিত আছে, হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) একটি পাথরকে বাহন বানিয়ে সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন কামেল পুরুষ ও শ্রেষ্ঠ সাধক হিসাবে সেখানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন এবং দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং সেখানেই গড়ে ওঠে বার আউলিয়া আস্তানা। পরবর্তীতে তা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কিছু সময় সেখানে অবস্থান করার পর মামা ভাগিনা কর্ণফুলীর উত্তর তীরে বর্তমান চট্টগ্রাম মূল শহরে চলে আসেন। হযরত বদর শাহ্‌ (রহ.) স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম শহরের বদর পট্টিতে (পরে নামকরণ) আস্তানা স্থাপন করলেও হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) পুনরায় আনোয়ারায় ফিরে এসে শঙ্খ নদীর উপকূলে ঝিউরী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং স্থায়ীভাবে আস্তানা গড়ে তোলেন। এরপর সে এলাকায় ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য ভক্ত ও মুরিদ সৃষ্টি হয়।

হযরত শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এর অনেক অলৌকিক ঘটনা, কাহিনী আজও মানুষের মুখে মুখে কথিত আছে। একদিন পার্শ্ববর্তী নদীর তীরে এক বোবা রাখাল ছেলে গরু চড়াচ্ছিল। তিনি ছেলেটিকে কাছে ডাকলেন এবং নাম ঠিকানা জানতে চাইলে ছেলেটি বোবা বলে বলতে পারল না। বাবাজান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে সে বাক শক্তি ফিরে পায়। ফলে তার মা বাবা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং এই অলৌকিক ঘটনার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ দলে দলে মুরিদ হতে থাকে।

ঝিউরী গ্রামের এক গোয়ালিনী প্রতিদিন বাবাজানকে গরুর দুধ দিত। একদিন গোয়ালিনী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলে দুধ নিয়ে আসে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আস্তানার নিকটে আসলে হোঁচট খেয়ে তার হাত থেকে সব দুধ মাটিতে পড়ে যায়। সে অনবরত কাঁদতে থাকে। অনেকে কান্না থামানোর চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। শাহ্‌ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) ঘটনাস্থলে যান, দেখলেন কলসিটি অক্ষত থাকলেও দুধ মাটিতে চুপসে গেছে। তখন তিনি মাটি চিবিয়ে দুধ বের করে কলসি পূর্বের ন্যায় ভর্তি করে দেন। আরেকবার সে সময়ে চট্টগ্রামে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হচ্ছিল না। ক্ষেত খামার পুকুর বিল সব শুকিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট উত্তপ্ত হয়ে যায়। পানির অভাবে মানুষের মাঝে হাহাকার পড়ে। ঝিউরী গ্রাম ও আশপাশের লোকজন শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এর নিকট আরজি করলে তখন তিনি সবাইকে নিয়ে জামাত সহকারে দুই রাকাত নামাজ আদায় শেষে মোনাজাত করেন। সাথে সাথে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। তাই এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রামে আষাঢ় মাসে বৃষ্টি বেশি হয় বলে জনশ্রুতি আছে। এই রকম আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা আছে যা প্রকাশ হলে দলে দলে বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের লোক হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) এর সান্নিধ্যে এসে ইসলামের উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয় এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। শ্রেষ্ঠ সাধক, ধর্ম প্রচারক মাহাবুবে রাব্বানী গাউছে ছামাদানী হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.) আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে অগণিত মানুষকে মুসলমান ও মুরিদ করেছেন। তিনি ৬ আষাঢ় ৯৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। শঙ্খ নদীর পাড়ে ঝিউরী গ্রামে এই মহান আধ্যাত্মিক পুরুষ, তরিকতের পথ প্রদর্শক হযরত মোহছেন আউলিয়া (রহ.) কে সমাহিত করা হয় ।

মাজার শরীফ অনেক পূর্বে নির্মিত হয়েছে বিধায় সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। তাই বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত মোতোয়াল্লী এস এম ফজলুল করিম তৎপুত্র এস এম ইলিয়াছ করিম, জহির উদ্দীন মাস্টার এবং অন্যান্য ওয়ারিশ ও খাদেমগণ খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র, দানবীর মোহাম্মদ মনজুর আলম আলহাজ্ব হোছনে আরামনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নতুন আঙ্গিকে, নতুন পরিকল্পনায় আরো বৃহদাকারে মাজার শরীফ পুনঃনির্মাণ করেন। এটি আধুনিক স্থাপত্যশৈলী হিসাবে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। কুতুবুল আউলিয়া হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ) এর আধ্যাত্মিক কৃপাদৃষ্টিতে আমাদের গ্লানিময় জীবন ধন্য ও আলোকিত করুন।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, ছোটদারোগার হাট তাহের মনজুর কলেজ। সাবেক উপাধ্যক্ষ, উত্তর কাট্টলী আলহাজ্ব মোস্তফাহাকিম কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গেলে নিজেকে পরিবেশবান্ধব হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবি