মহান আল্লাহ তা’আলা ও ছরকারে দো’আলম প্রিয় নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে মুমিন মুসলমানগণ হজব্রত পালন করে থাকেন। প্রত্যেকটি ইবাদতেরই আলাদা কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য থাকে। হজ এমন একটি ইবাদত যা আদায় করতে হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা এবং আর্থিক সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন।
হজের মূল কার্যক্রম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। তন্মধ্যে প্রথম ধাপ, এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় ও বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধিনে ন্যস্ত। দ্বিতীয় ধাপ, সৌদি রাজকীয় সরকারের হজ মন্ত্রণালয়ের অধিনে ন্যস্ত। উভয় সরকারের মূল কার্যক্রমকে একত্রীকরণে ভুমিকা রাখেন মূলত নিবন্ধিত হজ এজেন্সি ও সৌদি সরকার কর্র্তৃক নিযুক্ত মোয়াল্লেম সার্ভিস অফিস। বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দুইভাগে প্রেরণ করে থাকে। হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স, সৌদি এয়ারলাইন্স ও সৌদি আরবের আরেকটি সংস্থা ফ্লাইনাস এ তিনটি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী পরিবহন করে থাকে। অথচ হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে যদি সকল এয়ারলাইন্স উন্মুক্ত থাকত তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হয়ে বিমানভাড়া অনেক কমে যেতো এবং ২০–২৫ দিনে ফিরতি ফ্লাইটে হজযাত্রী হজের কাজ সম্পাদন করে দেশে ফিরতে পারতো, একজন হজযাত্রী হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদনে মাত্র ১৫দিন সময় দরকার। তন্মধ্যে বর্তমানে বিমান, সৌদিয়া ও ফ্লাইনাস কর্তৃপক্ষ ৪০–৪৫ দিন কোনো কোনো সময় ৫২ দিন পর্যন্ত সময় নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট দিয়ে থাকেন। যা হজযাত্রীদের ভোগান্তি ও দুর্ভোগ বাড়ায়। এমনিতে হজযাত্রী পরিবহন ছাড়া একজন সাধারণ ভিজিটর সৌদি আরবে আসা–যাওয়া ফিরতি ফ্লাইট ভাড়া ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার বেশি নয়। সেক্ষেত্রে বিমান হজযাত্রী পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে গিয়ে সৌদি ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্সকে অতিরিক্ত অধিক লাভে সুযোগ করে দিয়েছে। যা দেশের জন্যও ক্ষতিকর, কারণ এতে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকার ও কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিমানভাড়া নির্ধারণ ও থার্ড কেরিয়ার উন্মুক্ত করে ওপেন স্কাই ঘোষণা করলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হতো। এবছর বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় গত বছরের চেয়ে ৮০ হাজার টাকা কমিয়ে সি ক্যাটাগরি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ হজ প্যাকেজ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার এজেন্সি ও হজযাত্রীদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ করে দিল। কারণ গত বছরের হজ প্যাকেজ সি ক্যাটাগরির হজযাত্রীদের বাড়ির দূরত্ব ছিল ১৩০০ মিটার। আর এ বছর ঘোষিত হজ প্যাকেজে বাড়ির দূরত্ব রাখা হয়েছে ২০০০ মিটার অর্থাৎ হজ প্যাকেজের মূল্য কমানো হলো বাড়িভাড়া থেকে। এমনিতে বাংলাদেশে হজযাত্রীগণ দূরের বাড়িতে থাকতে অভ্যস্ত নন। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্যাকেজে ২০০০ মিটার দূূরত্বে যদি হজযাত্রী রাখা হয় তাতে নামাজের ওয়াক্তে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট এর কম সময়ে কোনো অবস্থাতেই হজযাত্রীগণ হেরেম শরীফে পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই এতে হজযাত্রীদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি বাড়বে কারণে নিয়মিত এজেন্সির সাথে হজযাত্রীদের ঝগড়া–বিবাদ লেগেই থাকবে। প্যাকেজ ঘোষণার প্রারম্ভে বাড়িভাড়া কাটছাট না করে বিমানভাড়া , মোয়াল্লেমসহ মোট ৫০ হাজার টাকা কমালে তাহলে এ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকত না। তাতে হজযাত্রীগণ খুশি হতো। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের যে সকল মোয়াল্লেম অফিসের মাধ্যমে সার্ভিস প্রদান করা হয় তাদের সার্ভিসগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়াতে হজযাত্রীদের ভোগান্তি লেগেই থাকে। যার দায়–দায়িত্ব এজেন্সির উপর এসে বর্তায়। অথচ সৌদি সরকার ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মোয়াল্লেমের সার্ভিস ফি সম্পূর্ণ আদায় করার পর একজন হজযাত্রী ভিসা পেয়ে থাকেন। এতে এজেন্সির কিছু করার থাকে না। এজেন্সির মালিক ও প্রতিনিধিরাও তাদের খারাপ আচরণে অসহায়ত্ব বোধ করেন। প্রথমত সৌদি মোয়াল্লেমের প্রথম সার্ভিস হজযাত্রীদের মক্কার বাসা হতে মিনায় ময়দানে যাওয়ার জন্য যে বাস সার্ভিস প্রদান করা হয় সে বাসগুলো বাছায় করার অধিকার এজেন্সির মালিকদের না থাকার কারণে কোনো কোনো মোয়াল্লেম নিম্নমানের পুরাতন গাড়ি সরবরাহ করে থাকেন। দুর্ভাগ্যবশত এরকম গাড়ি যদি কোনো এজেন্সির ভাগ্যে পড়ে থাকে সে এজেন্সির কপালে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। দ্বিতীয়ত, করোনা পরবর্তী মোয়াল্লেম ফি তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরও মিনা, মুজদালিফা ও আরাফার ময়দানে উল্ল্যেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। আরাফাতে তাবুর ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন এবং অপর্যাপ্ত এয়ারকুলার ও স্থায়ী তাবুতে পরিণত করা হলেও তা পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে হজযাত্রীদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। পর্যাপ্ত এয়ারকুলার ও টয়লেট–বাথরুম পর্যাপ্ত না থাকার কারণে হজযাত্রীদের দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না। মোয়াল্লেমদের আরো অধিক সংখ্যক তাবু ও এরিয়া বাড়ানো প্রয়োজন। আবার আরাফা থেকে মুজদালিফা যাওয়ার ক্ষেত্রে ৪৫ সিটের বাসে গাদাগাদি করে ১০০ জন হজযাত্রী তোলার নিয়ম থাকায় হজযাত্রীদের সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়। এক্ষেত্রে ৩গুণ মোয়াল্লেম ফি নেওয়ার পরেও কেন সিট অনুপাতে হজযাত্রীদের নির্ধারিত প্রয়োজন সংখ্যক বাস থাকবে না সেটা হজযাত্রীদের প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দিবে কে? আবার দেখা যায়, সরকারি হজযাত্রীদের মিনার তাবু ও বেসরকারি হজযাত্রীদের মিনার তাবু একই স্থানে না হওয়ায় হজযাত্রীদের হারিয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা ও সংকটে পড়তে হয়। এজন্য হজ চুক্তি করার সময় সরকারি ও বেসরকারি হজযাত্রীদের একই গুচ্ছতে রাখা বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে হজযাত্রীদের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি লাঘব হবে। সরকার হজযাত্রীদের প্যাকেজ ঘোষণা করার ক্ষেত্রে হজযাত্রীদের খাবার প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করে দিলেও খাবার পরিবেশনের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে থাকে। কারণ সরকারি হাজীদের খাবারের টাকা ফেরত দেওয়া হয়। তজ্জন্য সরকারি হজযাত্রীদের খাবার সংগ্রহে কষ্ট পেতে হয়। বিশেষ করে হজ যখন ঘনিয়ে আসে তখন হোটেলগুলোতে দীর্ঘ লাইন ধরে বেশি দামে খাবার কিনে খেতে হয়। আর বেসরকারি হজযাত্রীদের খাবার স্ব স্ব হোটেলে পাক করার অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী স্থান হতে ক্যাটারিং সার্ভিসের মাধ্যমে এ খাবারগুলো বেসরকারি হজ এজেন্সি পরিবেশন করে থাকে এবং গাইডদের মাধ্যমে হজযাত্রীদের রুমে রুমে পৌঁছে দিয়ে থাকে। সরকারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যাতে হজযাত্রীদের স্ব স্ব হোটেলে নির্ধারিত কিচেনে পাকের ব্যবস্থা করা যায়। এবারের প্যাকেজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখা গেল রিয়ালের মূল্যমান ধরা হলো সরকারি প্যাকেজের ২৯.৭০ পয়সা এবং বেসরকারি প্যাকেজে ৩১ টাকা। অথচ বর্তমানে রিয়ালের মূল্য ৩১ টাকার উপরে। যা হাস্যকর বটে। তাই এক দেশে দুই আইন হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার কিছু অনভিজ্ঞ গাইড হজযাত্রীদের সেবার জন্য নিয়ে যান তারা যেহেতু নিজেরাই অনভিজ্ঞ তারা কিভাবে হাজীদের খেদমত আঞ্জাম দিবে, তাই গাইড নির্বাচনের সময় অবশ্যই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলেম বা পূর্বে হজ আদায় করেছেন এই রকম ব্যক্তিদের গাইড হিসেবে নেয়া দরকার। হজ ২০২৪ নিয়ে সৌদি সরকার একটি চিঠি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ২০২৪ সনে হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে পত্র প্রেরণ করেছে। সে পত্রের মূল বিষয় হচ্ছে এজেন্সির প্রতি হজযাত্রীর সংখ্যা দুই হাজারে উন্নীত করা। হজযাত্রীগণ তাদের পছন্দসই এজেন্সি বেছে নিয়ে নিবন্ধন করেছেন। বাংলাদেশের ১৪০০ প্রায় হজ লাইসেন্স বেসরকারি হজযাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। এখন যদি ২০টা এজেন্সির হাজীকে একটা এজেন্সিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয় তাহলে হজযাত্রীদের সেবার ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম দেখা দিবে। কোনো অবস্থাতেই সৌদি সরকারের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া উচিত হবে না। এজেন্সি যার হাজী তার, সে হিসেবে প্রত্যেক এজেন্সি নিজ নিজ হাজীদের দেখভাল, সেবা শুশ্রূষা ও নিয়মিত দিক নির্দেশনা প্রদান করে হজযাত্রীদের সেবা প্রদান করে থাকেন। যদি এ সুযোগ থেকে এজেন্সি ও হজযাত্রীগণ বঞ্চিত হন তাহলে একদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ ধ্বংস হয়ে যাবে অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে। হজ একটি ইসলামের অন্যতম রোকন হিসেবে একজন অনভিজ্ঞ হজযাত্রীর হজের সার্বিক কার্যক্রম সহীহ শুদ্ধভাবে পরিপূর্ণ আদায় করানোর দায়িত্ব সরকার নিযুক্ত এজেন্সিগুলোর পালন করে থাকার কারণে বেসরকারি হজযাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুল আবেদন থাকবে যেন পূর্বের ন্যায় এজেন্সিগুলো হজযাত্রীদের সেবা দিয়ে যেতে পারে। সে ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর উদ্যোগ যেন গ্রহণ করা হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, হজযাত্রী কল্যাণ সংস্থা বাংলাদেশ, এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ই.ভি.পি.) আটাব