কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৩ জুন, ২০২৪ at ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ

চসিক, কার স্বার্থে কী করে বোঝা বড় মুশকিল

. সড়কের ধুলাবালি পরিষ্কারের জন্য ছয়টি গাড়ি পেয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এসব গাড়ি উল্টো ধুলা ছড়াচ্ছে। তাই অনেক টাকার গাড়িগুলো ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে। এভাবে ফেলে রাখতে রাখতে তিনটি গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি তিনটিও যাওয়ার পথে।

নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে দুটি নিলামে বিক্রি করতে গত ১০ মে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কোটি টাকা দামের গাড়িগুলো এখন বিক্রি করা হবে নিশ্চয়ই নামমাত্র মূল্যে।

শুধু ধুলা পরিষ্কারের এই ছয়টি গাড়ি নয়, অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে একটি আইসিইউ সুবিধাসম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স, দুটি অ্যাম্ফিবিয়াস এঙকাভেটর (উভচর খননযন্ত্র), একটি বিটুমিন স্প্রেয়ার ট্রাক (রাস্তায় বিটুমিন দেওয়ার গাড়ি) এবং খাদ্য পরীক্ষার ভ্রাম্যমাণ গাড়ি। এই ১১টি গাড়ির আনুমানিক দাম ১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ও খাদ্য পরীক্ষাগারের গাড়ি এক দিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। উভচর খননযন্ত্র ও বিটুমিন স্প্রেয়ার ট্রাক ব্যবহার হচ্ছে না চার বছর ধরে।

সিটি করপোরেশন রাস্তাঘাটের ধুলাবালি পরিষ্কারের জন্য ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ৫০ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনেছিল। কিন্তু তা কাজে আসেনি। এর তিন বছর পর ২০১৩ সালের ৮ জুন ধুলা পরিষ্কারের জন্য দুটি গাড়ি দেয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। গাড়ি দুটির দাম ছিল ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ২০টি রোড সুইপিং গাড়ি কিনেছিল। মন্ত্রণালয়ের বাজেটের মন্ত্রীর অভিপ্রায় খাত থেকে ‘রোড সুইপার’ কেনার ব্যয় বহন করা হয়। এই ২০টি গাড়ির তিনটি দেওয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে।

২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর গাড়িগুলোর উদ্বোধন করেছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। গাড়িগুলো চালুর পর থেকে গত সাড়ে তিন বছরে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ বার চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের চালকেরা।

ধুলা পরিষ্কারের এ গাড়িগুলো দেশের সড়ক উপযোগী নয় বলে দাবি করেন সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আকবর আলী। তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, এগুলো দিয়ে সড়ক পরিষ্কার করতে গেলে উল্টো আশপাশের এলাকা ধুলাময় হয়ে যায়। তাই এগুলো খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি। সর্বশেষ পাঁচ মাস আগে খুব ভোরে একবার ব্যবহার করা হয়েছিল।

২০২২ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে একটি আইসিইউ সুবিধাসম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স উপহার দিয়েছিল ভারত সরকার। এটির দাম কত, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সিটি করপোরেশনের চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের একটি অ্যাম্বুলেন্সের দাম এক থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত হয়। এই গাড়িটির দামও দুই কোটি টাকা হতে পারে।

উপহার পাওয়ার পর গাড়িটি এক দিনের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। গাড়িটি কখনো নগরের আন্দরকিল্লায় সিটি করপোরেশনের পুরোনো নগর ভবন প্রাঙ্গণে, কখনো সংস্থাটির দামপাড়া ইয়ার্ডে রাখা হয়। বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সটি নগরের দামপাড়া ইয়ার্ডে পড়ে আছে।

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং চাহিদা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতায় চারটি মাতৃসদন, একটি জেনারেল হাসপাতালসহ ৫০টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচারের সুবিধা রয়েছে। মহিউদ্দিন মেয়র থাকাকালীন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চিকিৎসাসেবায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর মান কমতে কমতে এখন শূন্যের কোটায় নেমেছে স্বাস্থ্যসেবা।

এ তথ্য আমার নয়। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের অংশবিশেষ।

মন্ত্রণালয় কিছু চাপিয়ে দেওয়ার আগে কি সিটি করপোরেশনের কারোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন না? তেমন কিছুর চাহিদা আছে কিনা, থাকলেও সেসব পরিচালনার সক্ষমতা আছে কিনা তাও কি খতিয়ে দেখবে না মন্ত্রণালয়? টাকা তো কারো ব্যক্তিগত নয়। জনগণের।

এভাবে সম্পদের অপচয় বোধ করি বাংলাদেশেই শুধু সম্ভব। কোনে জবাবদিহি নেই। কোনো প্রশ্ন নেই। যার যেমন ইচ্ছা তেমনই করে যাচ্ছে। জনগণের টাকার হরিলুট বন্ধ না হলে একদিন এর জন্য বড় খেসারত দিতে হবে।

২। মাসখানেক আগে মোমিন রোড দিয়ে রিকশায় ডিসি হিলে যাচ্ছিলাম। চেরাগী পাহাড় পেরিয়ে সামান্য গেছি। হঠাৎ রিকশা একটা মোচড় দিল আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল একটি অটোরিকশা। লেগে গেল দুজনের ঝগড়া। আমি অটোরিকশাচালককে বললাম, আপনি এভাবে ধাক্কা দিলেন কেন? উনি বললেন, রিকশাওলাই তো হঠাৎ ডানদিকে সরে গেছে। আমি রিকশাচালককে বললাম, তাতো ঠিক আপনি হঠাৎ এরকম করলেন কেন? রিকশাচালক আঙুল দিয়ে সড়কে রোড স্টাডদেখিয়ে বললেন, ‘এর উর্পে চাকা উঠলে রিকশায় জার্কিং হয় স্যার, সেইজন্য একটু ডানে সরছিলাম।

নগরবাসী অনেকে দেখেছেন, মোমিন রোড, জামালখান রোড, আশকার দীঘির পাড়, সার্সন রোডে সিটি করপোরেশন রোড লেনমার্ককরাসহ রোড স্টাড বসিয়েছে। রোড স্টাডস রাস্তা চিহ্নিতকারী হিসাবে কাজ করে, রাতের সময় দৃশ্যমানতা উন্নত করে এবং কম দৃশ্যমানতার অবস্থা, দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাস করে। তাছাড়া লেনের প্রান্ত, ছেদ এবং বক্ররেখা চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়, ড্রাইভারদের নির্দেশিত রুট মেনে চলতে এবং ড্রাইভিং ঝুঁকি কমানোর জন্য।

তীক্ষ্‌ণ বাঁক, স্পিড বাম্প এবং নির্মাণ এলাকার মতো বিপজ্জনক অঞ্চলগুলি চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োগ করা হয়, চালকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সতর্ক করে।

এগুলো সাধারণত ব্যবহৃত হয় মহাসড়কে যেখানে সড়কবাতি থাকে না। অন্ধকারে চালককে লেন বিভাজন বা লেনমার্ক বোঝাবার জন্য। এবার মহাসড়কের রোডস্টাডগুলো বসানো হয়েছে নগরের অভ্যন্তরে, যেখানে যথেষ্ট সড়কবাতি আছে এবং চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে রিকশা, অটোরিকশা, ভানগাড়ি ও ছোট যানবাহন অন্যতম। এই সড়কগুলোতে রিকশা, অটোরিকশা ও প্রাইভেট কারের মতো ছোট গাড়িতে চলাচল করেন তারা এই ভোগান্তিটা টের পাচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে হাড়ে হাড়ে।

যারা এমন কাজে সম্মতি দিয়েছেন তারা তো চলাফেরা করেন কোটি টাকা দামের জিপ গাড়িতে। এসব রোড স্টাড তাদের গাড়ির কোনো খবরই করতে পারে না। আর আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের যতবার রিকশা ও অটোরিকশার চাকা এই রোড স্টাডে উঠছে ততবার চাকার নিচে পাথর পড়ার মতো ঝাঁকুনি খাচ্ছেন। বয়স্ক এবং যাদের কোমরের ব্যথা আছে তাদের জন্য এই ঝাঁকুনি কষ্টকর হয়ে উঠছে। নগরের অভ্যন্তরে এ ধরনের সড়কে কোন যুক্তিতে এবং কার পরামর্শে রোড স্টাড বসানো হলো তার ব্যাখ্যা কি সিটি করপোরেশন দেবে? যেখানে এই প্রতিষ্ঠান অনেক জরুরি কাজই করতে পারে না, সে প্রতিষ্ঠান কেন অহেতুক একটি কাজ করতে গেল? এটা কি কাউকে তুষ্ট করার জন্য? অর্থাৎ কাউকে আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য? খামাখা রোড বিউটিফিকেশনের নামে, রোড স্টাডের নামে টাকাগুলোর শ্রাদ্ধ না করে খালখনন, খালে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার পেছনে অর্থ ব্যয় করুন। তাতে জনগণের লাভ হবে।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধহালিশহর থানার হত্যা মামলার আসামি সহযোগীসহ গ্রেপ্তার