পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎসব। ‘বারে বারে ঘুরে ফিরে ঈদ আসে, ঈদ চলে যায়, ঈদ হাসতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়।’ ঈদ শুধু ধনীর জন্য নয়, সবার জন্য। সবার মুখে হাসি ফোটানোই হলো ঈদের মাহাত্ম্য। ‘ ঈদ এসেছে ঈদ এসেছে ঈদ মোবারক, ঐ আকাশে চাঁদ উঠেছে দেখরে তোরা দেখ/ ধনী গরীব সবার ঘরে আজ,এলো ঈদের খুশি/ ফুটলো আবার দুঃখি জনের মলিন মুখে হাসি।’
ঈদ মানবসমাজের ধনী–গরিব ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়ার একটি দিন। ঈদের দিনে সবাই সমান। ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় হলো এক মহাসম্মিলন। ঈদগাঁহে ধনী–গরিব সবাই এক কাতারে, এক সমান। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ময়দানে একত্রিত হয়, আল্লাহ’তাআলা তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন, যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে তাদের কি প্রতিদান দেওয়া উচিত? ফেরেশতারা বলেন, তাদের পুণ্যময় কাজের সম্পূর্ণ পারিশ্রামিক দেওয়া উচিত। তখন আল্লাহতাআলা তাঁর মর্যাদার শপথ করে বলেন, অবশ্যই তিনি তাদের প্রার্থনা কবুল করবেন। এরপর আল্লাহ তাআলা ঈদের নামাজ সমাপনকারী তাঁর নেক বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আর তোমাদের কৃত অতীত পাপকে পুণ্যে পরিণত করে দিয়েছি।’
ঈদুল আজহা সাধারণত কোরবানের ঈদ হিসেবে পরিচিত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর অতি প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহপাকের আদিষ্ট হয়ে কোরবানি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহিম (আ.) পরীক্ষা করে দেখলেন। পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন। সে জায়গায় দেখা গেল একটা দুম্বা কোরবানি হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর অতুলনীয় আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবিচল আনুগত্যের ঘটনাটি বিশ্বসাহিত্যের উপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, তুরস্কের মতো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের সাহিত্যে নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে এর সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। সুদূর গ্রিসেও মহাকবি হোমারকে এ অসাধারণ আত্মত্যাগের ঘটনা প্রভাবিত করে। বিশ্বখ্যাত কবি হোমারের একটি মহাকাব্যের সাথে মীনার ঘটনা মিল পাওয়া যায়। মূলত মীনার ঘটনা হোমারকে আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা সাহিত্যেও ঈদুল আজহায় কোরবানি অনেককে আকৃষ্ট করেছে। বিশেষ করে নজরুলকে। তিনি কোরবানি কবিতায় লিখেছেন
-‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন/ দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহে খাম্খা ক্ষুদ্ধ মন/ ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর/ আজিকার এ খুন কোরবানির! দুম্বা–শির রুম–বাসীর/ শহীদের শির–সেরা আজি! রহমান কি রুদ্র নন/ ব্যস! চুপ খামোশ রোদন!….আজ আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন/ ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’ শুধু পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি সম্ভব নয়। এটা অলীক কল্পনা। এটা নজরুলের মনগড়া কথা নয়।
আল্লাহপাক বলছেন– ‘তোমাদের জবাই করা পশুর রক্ত–মাংসের আল্লাহ ফিরেও তাকান না, তিনি দেখেন তোমাদের মনের তাকওয়া।’ কোরবানির শিক্ষা হলো মনের পশুকে জবেহ করে নিজেকে খোদায়ী রঙে সাজিয়ে তোলা। সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা ও অধর্মের বিরুদ্ধে স্হসের সাথে গর্জে ওঠা। ঈদুল আজহা আত্মত্যাগে ডুবে যাওয়ার দিন। আজহা মানে হচ্ছে প্রভাতের ঝিলিমিলি আলো, যা অন্ধকার দূর করে দেয়। রাতের আঁধার ভেঙে নতুন সকাল নিয়ে আসে। নজরুল বলেছেন, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো বিদ্বেষমুক্ত প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলা। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ন্যায়–ইনসাফ–সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবে না। স্বার্থপরের জন্য জান্নাত হারাম। ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে/ মুসলিম নহে ভণ্ড সে/ ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/ দাও কোরবানি জান ও মাল/ বেহেশত তোমার কর হালাল/ স্বার্থপরের বেহেশত নেই।’ পোশাকি কোরবানিদাতাকে তিনি ঘৃণাভরে দেখেছেন। ‘নামাজ–রোজার শুধু ভড়ং/ ইয়া ঊয়া পরে সেজেছ সং/ ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম/ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়/ ত্যাগের বেলাতে জড়সড়/ তোর নামাজের কি আছে দাম!’
যদ্দূর জানা যায়, হিজরি দ্বিতীয় সন থেকে কোরবানি চালু হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কোরবানি দেয়া হয়। ঈদের নামাজ শেষে সামর্থবানরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানি দেয়া পশুর মাংস একা খেতে পারে না। একভাগ পাড়া–প্রতিবেশী–মিসকিন, একভাগ আত্মীয়–স্বজন, আরেকভাগ নিজে খাওয়ার জন্য। বাস্তবে সেটা আমরা অনেকে মানি না। নতুন নতুন ফ্রিজ কিনে কোরবানির মাংস রেখে দিই অনেকদিন খাওয়ার জন্য। এটা ঈদুল আজহার শিক্ষা নয়। ঈদুল আজহায় মুসলমানরা নতুন কাপড়– চোপড় পড়ে, আত্মীয়–স্বজনের বাড়িতে যায় এবং সবার সাথে কুশল বিনিময় করে। সবাইর সাথে একাট্টা হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার শিক্ষা দেয় ঈদুল আজহা।