প্রকৃতি চায় মানুষের সাহায্য অর্থাৎ বন্ধুত্ব। তা হলে প্রকৃতি বৈরী রূপ ধারণ করবে না। আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করি বলেই প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। আমরা স্বীয় স্বার্থে বনজঙ্গল উজাড় করি, পাহাড় কাটি, নদী–খাল–বিল ভরাট করি। ৫০–৬০ বছর আগে আমরা এসব করিনি তখন শহর গ্রামবাংলায় সৌন্দর্যের একটুও বিঘ্ন ঘটেনি। তখন অল্প খেয়ে অভাবের মধ্যে থেকেও সুখশান্তি ছিল আজকের চেয়ে বেশি। পাঁচ–ছয় দশক আগেও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামবাংলার চেহারা ও তৎপরতা বদলে যেত। গ্রামীণ উৎসবগুলোও ছিল ঋতুবৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করেই। আজ এ ঋতুবৈচিত্র্যের দেখা মেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তবে প্রযুক্তিনির্ভর এসব অনুষ্ঠানে গ্রামবাংলার আদি প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে অধিক হারে মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে জমির চাহিদা। চাহিদা পূরণে নির্বিচারে বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে। ভরাট করা হচ্ছে নদী ও খাল। কলকারখানা ও যানবাহনে মাত্রাতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে। ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরি করার জন্য গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক বন উজাড় করায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন–ডাই অক্সাইড শোষণ করার মতো পর্যাপ্ত গাছ আর থাকছে না। ফলে বায়ুমণ্ডলে এ ক্ষতিকর গ্যাস বেড়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে গাছপালা উজাড় করায় বায়ুমণ্ডলে অঙিজেন যাচ্ছে কমে। অক্সিজেন মানুষের বেঁচে থাকার উৎস। আর বনজঙ্গল বেঁচে থাকার উৎস হলো কার্বন–ডাই অক্সাইড। কলকারখানার বর্জ্য, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, বনভূমি ধ্বংস, নদ–নদী, জলাধার ভরাট, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার এসবই মানবসৃষ্ট। এসব কারণে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ুর। জলবায়ুর সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রচার এবং সচেতনতা। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিবেশ গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, গ্রিন হাউজ গ্যাস, কার্বন–ডাই অক্সাইড, মিথেন ও জলীয়বাষ্প নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা নিতে পারলেই একটি নিরাপদ বিশ্ব ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। এর ফলে একটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশ আমরা পাবো। জীববৈচিত্র্য আমাদের টিকিয়ে রেখেছে। পাশাপাাশি বিশুদ্ধ পানি, নির্মল বায়ু, রাসায়নিকযুক্ত জমি ও খাদ্য, প্লাস্টিক ও পলিথিন যুক্ত দ্রব্য বর্জন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিত উপায়ে করতে পারলে পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকবে। পরিবেশ নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। পরিবেশবান্ধব ফসল পেতে চাইলে সৌরপাম্প ব্যবহার করতে হবে। এতে বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে। জৈবসারের সাথে রাসায়নিক সার ভালো ফসল নিশ্চিত করে। এতে ফসল বেশি হবে। অকারণে কোনোভাবেই উদ্ভিদ কাটা যাবে না। কারণ উদ্ভিদের ত্যাগ করা অক্সিজেন প্রাণী শ্বাস গ্রহণের সময় ব্যবহার করে। বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যেসব কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন সেগুলো হলো– ১. বিশুদ্ধ পানি; ২. নদী ও খাল রক্ষা; ৩. দূষণমুক্ত বায়ু; ৪. বর্জ্য ও দূষণমুক্ত ভূমি ও জমি; ৫. পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস; ৬. পরিবেশবান্ধব ঘরবাড়ি নির্মাণ; ৭. শিশু ও কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ; ৮. বৃক্ষরোপণ; ৯. বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; ১০. খাল–বিল–জলাভূমি, পুকুর, দীঘি, লেক, হাওর–বাঁওড় রক্ষা; ১১. প্রাকৃতিক উদ্যান, চিড়িয়াখানা, নার্সারি রক্ষা; ১২. সুন্দরবন থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সব বনাঞ্চল রক্ষা; ১৩. নদীতে পলিথিন ও রাসায়নিক বর্জ্য ফেলায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা; ১৪. ভবন নির্মাণ যৌক্তিক নিয়মে হচ্ছে কি না সে বিষয়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা; ১৫. আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা পৃথকীকরণ ব্যবস্থা; ১৬. নগরীর রাস্তার প্রস্থ কমপক্ষে ১৫০ থেকে ৩০০ ফুট রাখা; ১৭. শব্দদূষণে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ; ১৮. জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও সচেতনতা অর্থাৎ নিজের কর্তব্য উপলব্ধি করা; ১৯. কক্সবাজার, পতেঙ্গা, পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা ও সেন্টমার্টিন প্রবালদ্বীপকে দূষণমুক্ত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা; প্রতিজ্ঞা করতে হবে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ব, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি জগৎকে সাজিয়ে রাখব আমরা– যেভাবে সৃষ্টিকর্তা সাজিয়ে দিয়েছিলেন সৃষ্টির ঊষালগ্নে। জলা নেই পানি নেই এটা হতে দেয়া যাবে না, বরং এসব সংরক্ষণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রকৃতি ও জীবন একে অপরের বন্ধু। এ বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবসমাজের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে প্রথম। পরিবেশ দূষণ রোধের সহজতম উপায় বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ পেতে প্রতিটি নাগরিককে বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশ দূষণ কমাতে প্রতিটি দেশের আয়তনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ বনভূমি নিশ্চিত করতে হবে। অতি প্রয়োজন ছাড়া গাছ কাটা নিষিদ্ধ করতে হবে। একসময় বাংলাদেশ ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দযের্র লীলাভূমি; এর মাঠঘাট, পাহাড়, নদীনালা, বায়ু সব কিছুই ছিল বিশুদ্ধ আর নির্মল। কিন্তু মানুষের তথা প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশের প্রধান তিনটি উপাদান, যথা– মাটি, পানি ও বায়ু নানা উপায়ে দূষিত হচ্ছে। এ দূষণ আমরা ঘটাচ্ছি জেনে আবার না জেনেও। যেসব কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো হলো– পলিথিন, যা নিষিদ্ধ হলেও তা রূপ বদলিয়ে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্জ্য হিসেবে পলিথিন সভ্যতার এক ভয়াবহ শত্রু। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সাবধান বাণী সত্ত্বেও পলিথিন সামগ্রিক ব্যবহার বাংলাদেশে বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পলিথিন এক অবিনাশী বর্জ্য; যেখানেই ফেলা হোক না কেন, এর শেষ নেই। পোড়ালে তা থেকে যে ধোঁয়া বের হয় তাও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার সারা দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেও তাতে আবার বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে গেছে। বন উজাড় করা একটি মানববিধ্বংসী রোগ। বনভূমির ওপর পরিবেশগত ভারসাম্য বহুলাংশে নির্ভরশীল। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ; কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমানে বনভূমি ১২ শতাংশের বেশি হবে না। জনসংখ্যা অনুপাতে দেশে বনভূমি থাকা উচিত ছিল ৩০ শতাংশ। বনভূমি উজাড় করে দেয়া দেশের পরিবেশগত সমস্যার অন্যতম বড় কারণ। পরিবেশগত সমস্যার আরেকটি হলো পানিতে আর্সেনিক বিষ। দেশের অনেক অঞ্চলে খাবার পানিতে আর্সেনিকের মতো মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর্সেনিক সরাসরি পাকস্থলীতে গেলে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটতে পারে।
আরেকটি ক্ষতিকর বিষয় হলো শব্দদূষণ। এটি শহর এলাকায় এক মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা বাস করছি হাইড্রোলিক হর্ন নামে এক ভয়ঙ্কর শত্রুর সাথে, যার উৎকট আওয়াজ প্রতিদিন একটু একটু করে চাপ বাড়াচ্ছে কানের পর্দার ওপর এবং ক্ষয় করে দিচ্ছে আমাদের শ্রবণক্ষমতাকে। এ ছাড়া আমাদের হার্ট আর শ্রবণযন্ত্রের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য রয়েছে মাইকের বিকট আওয়াজ, বাড়ি নির্মাণ ও কলকারখানার শব্দ। এ ভয়ানক শব্দদূষণ পরিবেশগত বিপর্যয়কে আরো ঘনীভূত করছে। ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানো এবং কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য কৃষকরা অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার করছেন– তা মাটির উর্বরাশক্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। খাদ্যপ্রাণ বিনষ্ট করে দিচ্ছে ফসলের। এগুলো অতিমাত্রায় ব্যবহারের দরুন পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি টিলা ও পাহাড় কাটা, নদী ভরাট, নগরের অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন, এসব কিছুই সুস্থ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। সচেতনতার অভাবে আমাদের পরিবেশ আজ বসবাসের অযোগ্য। কলকারখানা ও যানবাহনের বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর গ্যাস, ইটের ভাটায় ধোঁয়া, শিল্পে বিষাক্ত বর্জ্য প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অবাধে বৃক্ষ নিধনে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যাচ্ছে দ্রুত, বাড়ছে সিসা, বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির পক্ষী ও বন্যপ্রাণী। নদীতে পানি দূষণে মাছের সংখ্যাও কমে আসছে, বিভিন্ন কারণে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত, হারিয়ে ফেলছে এর ভারসাম্য। পরিবেশ সমস্যার সমাধান করতে হলে অনবরত বনায়ন করতে হবে। শব্দদূষণ রোধের কঠোর আইন করতে হবে। পলিথিন বর্জন করতে হবে এবং পুরনো আইনকে সুন্দর করে ঢেলে সাজাতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর যদি আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে অধিক প্রচারণা চালায় ও জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে তা হলে বিপর্যয়ের হাত থেকে আমরা অনেকটা নিরাপদ থাকতে পারব। পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো নিঃশব্দ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই বর্তমান সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে জনস্বার্থে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা। পৃথিবীর ১০টি ভালো শহরের কথা উল্লেখ করলে আমরা দেখতে পাবো– সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মানুষের বেশি বাস করে না। কিন্তু এখানে এর বিপরীত চিত্র। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে কমপক্ষে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মানুষ বাস করে। যেখানে মানুষ বেশি, সেখানে বর্জ্য ও ময়লা বেশি। তিন লাখের জায়গায় ২০ লাখ গাড়ি, ভবনের সংখ্যা বেশি। এসব কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি। শহরের ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ শিশুর ফুসফুস স্বাভাবিকের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বয়স্করা ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগে ভুগছেন। শ্যামলিমার অভাবে শহর হয়ে উঠছে মরুভূমির মতো রুক্ষ। দুঃসহভাবে বেড়ে উঠেছে শহরের উত্তাপ। এসব কারণেই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ গভীরতর অসুখে পড়েছে, দেশকে বাঁচাতে প্রয়োজন সবুজের সমারোহ। আসুন, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশের প্রকৃতিকে সবুজ দিয়ে সাজিয়ে তুলি; প্রকৃতি–পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি; এভাবে বাংলাদেশকে বাঁচাই এবং আমরাও বাঁচি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ।