নগরের পতেঙ্গায় মনিরুজ্জামান রাফি (২৫) হত্যাকাণ্ড পূর্ব পরিকল্পিত নয়। তবে এর সঙ্গে ‘কিশোর গ্যাং’–এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ঘটনায় জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধৃতরা হচ্ছেন– জাহিদুল ইসলাম (২২), মোবারক হোসেন (২৩), ইকবাল হোসেন ইমন (২২), শাহরিয়ার আল আহমেদ (২০), তাহরিয়ার আহমেদ বাঁধন (২০), মারুফ চৌধুরী (২১) ও জুবায়ের বাশার (৩৪)।
গতকাল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ–কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। এ সময় রাফির মা জান্নাতুল ফেরদৌস তার ছেলে হত্যার উপযুক্ত বিচার দাবি করেন।
জানা গেছে, বিকট শব্দে মোটরসাইকেল চালানোকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটি ও মারামারির এক পর্যায়ে রাফিকে গত ৯ জুন ভোরে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এসময় আহত হন রাফির বন্ধু রায়হানও। এ ঘটনায় রাফির মা বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারসহ ঘটনার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
শাকিলা সোলতানা বলেন, রোববার ভোর চারটার পরে আমাদের কাছে খবর আসে, মোটরসাইকেলের সাইলেন্সরের বিকট শব্দ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একগ্রুপের চার থেকে পাঁচজন, অন্যগ্রুপে ১৪ থেকে ১৫ জন ছিল। তদন্তে জানা গেছে, ১৫ জনের গ্রুপটি চারজনের গ্রুপের ওপর হামলা করে। হামলার একপর্যায়ে রাফিকে অপর পক্ষের লোকজন ছুরিকাঘাত করে ও তার বন্ধু রায়হানকে মারধর করে। গুরুতর আহত অবস্থায় দুইজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাফিকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছুরিকাঘাত যে করেছে, সেই মোবারক হোসেনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, রাফি ও তার বন্ধু মো. রায়হান, তানজিল, রাজুসহ কোরবানির পশুরহাটে গরু দেখা শেষে রাত ৩টার দিকে দুটি মোটরসাইকেলযোগে সী–বিচে যায়। এসময় তাদের মোটরসাইকেলের সাইলেন্সার পাইপের বিকট শব্দ করাকে কেন্দ্র করে সি–বিচ এলাকায় অবস্থানরত কয়েকজন ছেলের সাথে বাকবিতণ্ডা ঘটে। যা স্থানীয় লোকজন সেখানকার ব্যবসায়ী রবিনের দোকানে উভয়পক্ষের মধ্যে মিটমাট করে দেয় এবং যে যার মত চলে যায়। পরে রাফি ও তার বন্ধুরা মোটরসাইকেলযোগে রওয়ানা হলে ভোর সাড়ে চারটির দিকে সী–বিচে প্রবেশ পথের গোলচত্বরে পৌঁছুলে তাদের উপর পূর্বের বাকবিতণ্ডার জের ধরে হামলা করে মারধার করে। এক পর্যায়ে মোবারক হোসেন ধারালো টিপছোরা দিয়ে রাফিকে এলোপাথাড়ি গলার বাম পাশে, বাম হাতের কনুইয়ের নিচে ও ডান পায়ের উরুতে আঘাত করে। অন্য আসামিরা রায়হানকে আঘাত করে।
শাকিলা সোলতানা বলেন, এটি কিশোর গ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ড ধরে নেওয়া যায়। কারণ যারা এ কাজ করেছে তারা প্রায়ই অনেকেই সদ্য কৈশোর পার করা উঠতি বয়সের তরুণ। এরা গভীর রাতে কিংবা ভোরে মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্নস্থানে ঘোরাঘুরি করে। তারা বীচে গিয়ে মারামারি করবে, এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
শাকিলা সোলতানা বলেন, মোটরসাইকেলের সাইলেন্সরের উচ্চশব্দ নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়। এর জেরে খুন। এটি তাৎক্ষণিকভাবে ঘটানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় আমাদের পাড়া–মহল্লায় যেসব কিশোর গ্যাংয়ের ঘটনা ঘটে, সেগুলোর অনুরূপ। এটা আমি সামাজিক অবক্ষয় বলব। কাউকে সহ্য না করা, সম্মান না করা বা ধৈর্য্যর সঙ্গে কোনো কিছু মোকাবেলা না করা– এরকম অশোভন পরিবেশ আমাদের এখানে তৈরি হয়েছে।
রাফির মা যা বললেন :
রাফির মা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আামার ছেলে খুব সহজ সরল। কোনো আবদার থাকলে আমার কাছেই করত। সর্বশেষ শনিবার রাত দুইটার দিকে আমি আমার ছেলেকে কল দিই। সে কল ধরে বলে আম্মু আমি চলে আসব, তুমি টেনশন করো না। সে আমাকে বাড়ির গেট বন্ধ করে দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে বলে। ভোর হয়ে গেলেও যখন রাফি আসছে না, তখন আমি অনবরত তাকে কল দিতে থাকি। সে যখন কল ধরছিল না, তখন আমার ভয় হয়। আমি আমার মাকে তাকে কল দিতে বলি। আমার মা কল দিলে রাফির মোবাইল অন্য একজন ধরে বলে রাফি অ্যাঙিডেন্ট করেছে। আমরা যাতে তাড়াতাড়ি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাই। আমার ছোট ভাইসহ তাড়াতাড়ি মেডিকেলে গিয়ে শুনি সে মারা গেছে।
তিনি বলেন, আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমার তো আর কেউ নেই। আমি এ ছেলের আশায় বেঁচে ছিলাম। আমার ছেলে চাকরি করে। সে বলেছিল– আম্মু আমি তোমাকে টাকা দেব বেতন–বোনাস পেলে। নানুকে আর মামাকে টাকা দিও। আমার কিছু ধারকর্জ ছিল। সেগুলোও পরিশোধ করার জন্য সে টাকা দেবে বলেছিল। আমার ছেলেকে ওরা কীভাবে মেরে ফেলল ! আমি বিচার চাই।’
উল্লেখ্য, মায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার পর দক্ষিণ–মধ্যম হালিশহরের বাকের আলী ফকিরের টেক এলাকায় নানা বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতেন রাফি। সিইপিজেডে ইয়ংওয়ানের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন তিনি। রাফির মা সাংবাদিকদের বলেন, বিয়ের একবছর পর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর আমি মায়ের বাড়িতে চলে আসি। সেখানেই আমার ছেলের জন্ম হয়। তাকে নিয়েই আমি আমার মায়ের বাড়িতে থাকতাম। আমার মা আমাকে আর ছেলেকে লালন–পালন করেছে। আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে আমি আর বিয়ে করিনি। আমি বিয়ে করলে তাকে কে দেখবে। বিয়ের জন্য অনেক প্রস্তাব এসেছিল।