আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, দুইটি বাক্য এমন রয়েছে যা বলা সহজ ও আমলের পাল্লায় অনেক ভারী। আর আল্লাহর কাছেও অধিক পছন্দনীয়। সেটি হলো: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম। বুদ্ধিমান মুমিন কল্যাণের প্রতি ধাবিত হয়। যেসব কাজে আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন যেসব কাজ তাঁর নিকটবর্তী করে সেসব কাজে আগ্রহী হয়। যেসব কাজ তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা এড়িয়ে চলে। বিরত থাকে সেসব কাজ থেকেও যা তার দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির কারণ হয়। এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের ভিত্তিতেই তাঁর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন করা হয়। তাই ইসলাম মানুষকে উত্তম ও কল্যাণকর কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যেসব কাজকে ‘খায়ের’ তথা কল্যাণকর বা উত্তম বলেছেন তার মধ্যে সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ নেক আমলসমূহ বর্ণনা করা হলো : পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন কেউ অণুপরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণুপরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে। (সূরা জিলজাল,আয়াত : ৬–৮)। হাশরের ময়দানে মানুষ আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নামের ভয়ে পেরেশান থাকবে। একটি নেকির জন্য পাগলের মতো ছুটবে। কিন্তু আল্লাহর দয়া ছাড়া কোনো কিছু কাজে আসবে না। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় নবীজির (সা.) কাছে এসব আমল খুব প্রিয় ছিল। জান্নাত লাভের সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ নেক আমলসমূহ :
১. ফজরের দুই রাকাত সুন্নত : আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম। অন্য বর্ণনায় এসেছে নবী (সা.)-কোনো নফল (ফরজ/ওয়াজিব নয়–এমন) নামাজকে ফজরের দুই রাকাত সুন্নতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন না।
২. নামাজে বিনম্র হওয়া : নামাজে শরীর টানটান করে রাখার পরিবর্তে নরম তথা স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে দেওয়া উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা যারা নামাজের মধ্যে নিজের কাঁধ বেশি নরম করে দেয়।
৩. তিন তাসবিহ পাঠ : প্রত্যেক নামাজের পর তিন তাসবিহ পাঠের বিশেষ গুরুত্ব আছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন আমি কি তোমাদের এমন কিছু কাজের কথা বলব যা তোমরা করলে যারা নেক কাজে তোমাদের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে। তবে যারা পুনরায় এ ধরনের কাজ করবে তাদের কথা স্বতন্ত্র। তোমরা প্রত্যেক নামাজের পর ৩৩ বার করে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) এবং তাকবির (আল্লাহ আকবার) পাঠ করবে। অন্য বর্ণনায় ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠের কথা এসেছে।
৪. কোরআন পাঠ ও পাঠদান : উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।
৫. অসহায় মানুষের জন্য ব্যয় : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ওপরের হাত উত্তম নিচের হাত থেকে। ওপরের হাত হলো খরচকারী হাত নিচের হাত হলো গ্রহণকারী হাত।
৬. মাতাপিতার সঙ্গে সদাচরণ করা : মাতা–পিতার সন্তুষ্টিতে সন্তানের জন্য জান্নাত আর তাদের অসন্তুষ্টির মধ্যে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম। হাদিসে বলা হয়েছে যে সন্তানের ওপর তার মাতা–পিতা রাজি রয়েছে তার ওপর আল্লাহতায়ালাও রাজি রয়েছে। জীবনের কঠিন ও উত্তপ্ত মুহূর্তেও মাতা–পিতার সঙ্গে সদাচরণের সীমা লঙ্ঘন করার সামান্যতম অনুমতি আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।
৭. মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় : আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করল সে যেন হজ করে আসল। আর যে ব্যক্তি নফল নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেল সে যেন ওমরা করে ফিরল।
৮. প্রথম ওয়াক্তে নামাজ : উম্মে ফারওয়া (রা.)-হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) কে উত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন ওয়াক্তের প্রথম ভাগে নামাজ আদায় করা সর্বোত্তম আমল।
৯. আহার করানো ও সালাম দেওয়া : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি নবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেন ইসলামের কোন আমলটি উত্তম ? তিনি বলেন আহার করানো এবং পরিচিত–অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া।
১০. মা–বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, যথাসময়ে নামাজ ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ : ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি (সাহাবি) রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন কোন আমল সবচেয়ে উত্তম? তিনি বলেন যথাসময়ে নামাজ আদায় করা মা–বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা অত:পর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।
১১. পরিবারের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা: আয়েশা (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি তোমাদের মধ্যে আমার পরিবারের কাছে উত্তম।
১২. সার্বক্ষণিক জিকিরে থাকা : আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রা.) বলেন একবার এক বেদুঈন রাসুল (সা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি (সা.) বলেন সৌভাগ্যবান ওই ব্যক্তি যে দীর্ঘ হায়াত পেয়েছে এবং যার আমল নেক হয়েছে। সে ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসুল কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি (সা.) বলেন তুমি যখন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে তখন তোমার মুখে আল্লাহর জিকিররত থাকবে।
১৩. নবীর ওপর দরুদ পাঠ করা: হজরত আনাস (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তার প্রতি ১০টি রহমত নাজিল করবেন, তার ১০টি গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং ১০টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।
১৪. সুরা ইখলাছের ফজিলত: রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন তোমরা কি কেউ প্রতি রাতে কোরআন শরিফের এক–তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে অক্ষম? তাহলে সে প্রতি রাতে সুরা ইখলাছ পড়বে। তাহলে কোরআনের এক–তৃতীয়াংশ তিলাওয়াতের সওয়াব পাওয়া যাবে।
১৫. রোগী দেখার ফজিলত : রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের রোগের খোঁজখবর নেয় আল্লাহ সত্তর হাজার ফেরেশতাকে তার মাগফিরাতের দোয়ায় নিযুক্ত করে দেন। সে দিনের যে সময়ই তা করবে ফেরেশতারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করবে। আর রাতের যে সময়ই করবে ফেরেশতারা ফজর পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করবে।
১৬. সদকায়ে জারিয়াহ: রাসুলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেন যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তিনটি জিনিস বন্ধ হয় না–সদকায়ে জারিয়াহ ও ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়; সুসন্তান যে তার মৃত বাবার জন্য দোয়া করে।
১৭. তাহাজ্জুদ: মহানবী (সা.) বলেছেন ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদের নামাজ। ঈমানদারের গুণাবলি বর্ণনায় আল্লাহতাআলা বলেন তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগতপরায়ণ আল্লাহর পথে ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনাকারী। (সুরা আলে ইমরান : ১৭) আল্লাহপাক ক্ষমাশীল, তিনি চাইলে আমাদের ক্ষমা করতে পারেন আমাদের কাজ হচ্ছে ক্ষমা চাইতে থাকা আর দোয়া করতে থাকা। দোয়া করার উত্তম একটি সময় হল গভীর রাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সময়।
আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ও নবীজি (সা.) নিকট যে আমলগুলো অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় সেগুলো করার তাওফিক দান করেন এবং আমাদের জন্য তার সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করেন আমাদের শেষ পরিণতি যেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত করেন। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন!
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।