মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে শুধু নিজের দেশকে নয়; বিশ্বের সকল নাগরিকের জন্য তাঁর কন্ঠ উচ্চকিত। মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, গাজায় ইসরাইলের অবর্ণনীয় গণহত্যাসহ বিশ্বজুড়ে সকল নির্যাতনের বিরুদ্ধেই তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। এসব উচুমার্গের মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি আজ বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিশ্বদরবারে তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতার মা’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনসহ স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২ তম অধিবেশনে পাঁচটি এবং ৭৪ তম অধিবেশনে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা তাদের প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে প্রয়োজনীয় মানবিক সাহায্য অব্যাহত রেখেছে। নিরাপদ–স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহে আধুনিক সুযোগ–সুবিধার সমন্বয়ে ভাসানচরে এক লাখের অধিক রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা সর্বমহলে প্রশংসিত।
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণে মিয়ানমার সামরিক জান্তার কদর্য অভিপ্রায় সহজেই অনুমেয়। রাখাইন রাজ্যের টাউনশিপ বুথিডং ও মংডুতে শত শত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মালিকানাধীন ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে শহরগুলোর দখলে নেওয়া আরাকান আর্মি এই অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও আরাকান আর্মি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা এই ঘটনার জন্য মিয়ানমার সেনাদের দোষারোপ করছে। ২৪ মে জেনেভায় জাতিসংঘের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শহর দুটি থেকে সেনাদের পশ্চাদপসরণ এবং আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের দুই দিন পর বা ১৭ মে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের সূত্রে উক্ত সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, আরাকান আর্মি স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করছে। এসময়ে প্রায় চারজনের শিরচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে সরকারি বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক যুদ্ধে নামানো এবং মার্চে বুথিডংয়ে সংঘাত বিরোধী রোহিঙ্গা বিক্ষোভের পর থেকে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাবিরোধী হিংসাত্মক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে একপ্রকার অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচ্য।
বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে নিয়মিত যোগযোগ বজায় রাখতে হবে। যার মধ্যে চীন, ভারত বা আসিয়ান থাকবে। বিশ্বের যেসব পরাশক্তি এখানে প্রভাববলয় তৈরির চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য ও গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে হবে। গতানুগতিক কূটনীতি দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখে এসেছি। সময় এসেছে আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী তাদের নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে হলেও কোনো না কোনো সংযোগ স্থাপন করা। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনার বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে। মিয়ানমার জান্তা সরকারের কাছেও এটি এখন আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। ফলে এ ব্যাপারে অন্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে হয়তো পরিস্থিতি বিবেচনায় ভবিষ্যতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকব।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে; সঙ্কট নিরসনে তা এক ধরনের অন্তরায় বিবেচনায় সচেতন মহলে গভীর কৌতুহলের জন্ম দিচ্ছে। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য; চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে। এত বিশাল সংখ্যক বিদেশী শরণার্থীর কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান শুধু ঐ অঞ্চলে নয়; পুরো দেশেই অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুরাশার দৃশ্যপট নির্মাণ করে। নিরাপত্তাজনিত–পরিবেশগত–নানামুখী অপরাধ সংঘটনে এই জনগোষ্ঠীর কদর্য কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় নিগূঢ় প্রতিবন্ধকতা পরিগ্রহ করেছে। মূলতঃ এই সমস্যা সমাধানের মূলে রয়েছে মিয়ানমার সরকারের ইতিবাচক আগ্রহ ও ঐকান্তিক স্বদিচ্ছা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যথার্থ চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তারে যৌক্তিক সমাধান নির্ধারণের বিপরীতে পরাক্রমশীল দেশসমূহের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ক্রমাগত ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্কের সমৃদ্ধি সমস্যাকে প্রলম্বিত করছে। গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দুটি মামলা চলমান আছে। আদালতের রায় অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা থেকে রক্ষার নির্দেশ প্রদান করা হলেও মিয়ানমার সরকার এই রায়কে শুধু অবজ্ঞা নয়; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা ধরনের প্রভাববলয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সঙ্কট উত্তরণে কোন ধরনের পদক্ষেপকেই বিবেচনায় নিতে আগ্রহী নয়।
অতিসম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল পররাষ্ট্রনীতির ওপর প্রভাব স্পষ্ট নয়। প্রাপ্ত ফলাফলে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের সম্ভাবনা অনেকখানি ধোঁয়াশা। পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভবিষ্যৎ অবস্থান উপলব্ধি দুরূহ বিষয়। বিগত সময়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে প্রতিশ্রুতি সমূহের কার্যকারিতা এখনও বোধগম্য নয়। যদিও বিভিন্ন সময়ে ভারত বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট ‘মানবিক বোঝা’ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের ২৬তম সম্মেলনে প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে ভারত বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে উল্লেখযোগ্য আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে।
দেশবাসী ও পুরোবিশ্বের সমগ্র সচেতন নাগরিক পরিপূর্ণ অবহিত আছেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকার পরিচালিত বর্বরতম অভিযানে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার প্রায় বার লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বর্তমানে ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। ইতিমধ্যে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য নান্দনিক আবাসনসহ পর্যাপ্ত সুবিধা সম্বলিত ভাসানচরে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। সময়ের আবর্তনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি নগণ্য ঘটনা থেকে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, পূর্ব শত্রুতার জের, ধর্ষণ, অসামাজিক কার্যকলাপ, হত্যা, মানব–মাদক–অস্ত্রপাচারের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। ক্যাম্প এলাকায় গড়ে উঠেছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও অভিযানেও রোহিঙ্গাদের নানামাত্রিক অরাজকতা প্রতিহত করা অনেকটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় শ্রম বাজারে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ এবং তাদের এমন হীন–সহিংস কর্মকান্ড প্রশাসনের পাশাপাশি এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদেরও উদ্বেগ–উৎকন্ঠার কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
জাতীয়তা সনদ–এনআইডি–পাসপোর্ট গ্রহণে অবৈধ উপায় অবলম্বনে রোহিঙ্গাদের অপতৎপরতা পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তুলছে। এই বিশাল আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নানামুখী অপকর্ম কক্সবাজারসহ পুরো অঞ্চলকে দুর্বিষহ ও বিপর্যস্ত করে চলেছে। অনিয়ন্ত্রিত অপরাধ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তার অভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা আতঙ্কে দিনযাপন করছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের অভিমত হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সশস্ত্র দলগুলোর তৈরি করা ত্রাসের রাজত্বের কারণে সম্প্রতি ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তার পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। হিংস্র দানবতুল্য নরপশুদের দেশবিরোধী কার্যক্রম ঐপারে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে অনেকবেশি উৎসাহিত করছে। তারা সীমান্ত এলাকায় জড়ো হয়ে যেকোন সময় বাংলাদেশে প্রবেশের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
সার্বিক পর্যালোচনায় এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা আশ্রয় বড় মাপের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন যুদ্ধ–সংঘাতের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট প্রকট। এই দুঃসময়ে রোহিঙ্গাদের ভার বহন করা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মোটেও সহনীয় পর্যায়ে নেই। জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র–দাতা সংস্থাসমূহের অনুদান–সহযোগিতা বহুলাংশে সীমিত হয়ে আসছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় উন্নত রাষ্ট্রের কোন উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত কোন সফলতা আনতে পারেনি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের করণীয় কী একার পক্ষে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুঃসাধ্য। কালক্ষেপণ না করে অধিকতর কূটনৈতিক সংযোগ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্র–স্বরাষ্ট্র–প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রায়োগিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, রোহিঙ্গা সমস্যা চিরস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আলোয় উদ্ভাসিত হউক, দেশবাসীর মত আমিও এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়