এ শহরের বুকশপগুলো

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

কুমার প্রীতীশ বল | বুধবার , ৫ জুন, ২০২৪ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

মাঝে মাঝে মনে হয় এই শহরটার নিচে আরেকটা শহর আছে। তার নিচে আরেকটা, তারপর আরো আরো শহর। শহরগুলো পরিত্যক্ত নয়। সেখানে সাজানো আছে বহু গল্প, কত দিবারাত্রির সুঘ্রাণ। আমি হয়তো একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবার সময় এই শহরগুলোকে ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু সব গল্প মনের মধ্যে থেকে যাচ্ছে রূপকথা হয়ে।’ ইরাজ আহমেদের ‘মনে পড়ে ঢাকা’ গ্রন্থের পঙক্তিগুলো করোটির ভেতর ঘুমিয়ে থাকা স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের অনেক গল্পের একটি বুকশপের গল্পগুলো জাগিয়ে তোলে।

স্কুলকলেজের পাঠ্যবই যেসব দোকানে থাকত, ওগুলোকে বলতাম লাইব্রেরি। লাইব্রেরিগুলোতে তেমন যাতায়াত ছিল না। আন্দরকিল্লার পাঠকবন্ধু লাইব্রেরির সুনাম ছিল। আসাযাওয়ার পথে দোকানটিতে সবসময় ভিড় দেখতাম। আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ মার্কেটে অনেক লাইব্রেরি ছিল। আন্দরকিল্লায় অবস্থিত একসময় কোহিনূর লাইব্রেরি, ইসলামিয়া লাইব্রেরি’র বহুল পরিচিতি ছিল। এদুটো আমরা দেখিনি। ‘সিগনেট লাইব্রেরি’ ছিল ব্যতিক্রম। এখানে পাঠ্যবই ছিল না। অধ্যক্ষ যোগেশ সিংহের ‘ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ’ বইটির জন্য ওখানে যেতাম। অনেক কপি কিনেছি। অনেক বিবাহে উপহার দিয়েছি। বইটার দাম ছিল কম।

আমাদের আকর্ষণ ছিল যেসব বুকশপের প্রতি, ওখানে পাঠ্যবই ছিল না। দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা, গল্পকবিতাউপন্যাসপ্রবন্ধনাটকের বই বিক্রি হতো। এসব বুকশপে নিয়মিত যাতায়াত একধরনের নেশা ছিল। এখানে অনেক মহৎপ্রাণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বুকশপগুলোর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বুকশপটির নাম ছিল ‘কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি’। জুবলি রোড থেকে হকার মার্কেটের পাশ দিয়ে আদালত ভবনের পাহাড়ে উঠতে হাতের বামদিকে ওটার অবস্থান ছিল। শুনেছি ঢাকা, সিলেট, করাচিতে ‘কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি’র শাখা ছিল। দোতালার বিশাল কক্ষটিতে এক/দু’বার গিয়েছিলাম। হতাশ হয়ে ফিরেছি। নিষ্প্রাণ দোকানটিতে তখন প্রয়োজনীয় বই পাওয়া যেত না। একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ওখান থেকে ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ পত্রিকা যাত্রা শুরু হয়।

জুবলী রোডে জলসা ভবনের নিচে ছিল ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’। ‘বই হোক নিত্য সঙ্গী’ স্লোগান দিয়ে বইফেরি করত। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে স্লোগান। ব্যতিক্রমই মনে হতো। ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’ মালিক হলেন মোহাম্মদ আমিন সাহেব। তাঁর দুই সন্তান মুবিন ও শাহীন। তাঁরা পালাক্রমে বসতেন। এ তিনজনের সঙ্গে আরেক ছিলেন আমিন সাহেবের ভগ্নিপতি। আমিন সাহেব ডান হাতে ঘড়ি পড়তেন। খুব অমায়িক মানুষ ছিলেন। দোকানে গেলে কথা হতো। ভয় পেতাম তাঁর ভগ্নিপতিকে। কেমন যেন রাশভারি লোক ছিলেন। ১৯৮৮ সালে মিমি সুপার মার্কেটে ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’র আরেকটি শাখা খুলে। ওটাতে খুব বেশি যাইনি। জলসা ভবনের বুকশপে নিয়মিত যেতাম। আমিন সাহেবের আদিবাড়ি ঝালকাঠি জেলায়। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম এসে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ‘স্ক্রীন এন্ড কালচার’ নামে একটি বুকশপ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে তা স্থানান্তর হয় সিডিএ বিল্ডিংএর নিচ তলায়। নাম দিলেন ‘সিডিএ বুক হাউজ’। ১৯৬৭ সালে জুবলী রোডে জলসা সিনেমা হলের নিচে আবার স্থানান্তরিত হয়। তখন নামকরণ করেন ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’। ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’র প্রবীণ কর্মচারী ছিলেন ফজলু ভাই। সহজসরল, শান্ত, হাসিমুখের এমন মানুষ কম দেখেছি। তিনি এখানে নিয়মিত যাতায়াতকারীদের খুব যত্ন করতেন। কে কেমন বইপত্র খোঁজেন জানতেন। তেমন বইপত্র আসলে রেখে দিতেন। আমাদের নামে খাম ছিল। দেশ, সানন্দা, ভ্রমণ, পরিচয়, জিজ্ঞাসা আসলে ফজলু ভাই খামে ঢুকিয়ে রাখতেন। ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’ বেশি জনপ্রিয় ছিল দেশ বিদেশের লিটলম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকার জন্য। ঢুকতেই লিটলম্যাগাজিনের জন্য বিশাল টেবিল ছিল। এখানে দেশবিদেশের লিটলম্যাগাজিন থাকত। এমনকী দু’পাতার ফোল্ডারও পাওয়া যেত। আমিন সাহেব লিটলম্যাগাজিনের প্রকাশকদের স্নেহের চোখে দেখতেন। শুনেছি, অনেককে অগ্রিম টাকা দিতেন। ক্যাশ কাউন্টারের ডানদিকে লম্বা টেবিলে ছিল ভারতীয় সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক। ক্যাশ কাউন্টারের পাশে একটা টুল থাকত। বিশেষ কেউ গেলে ওখানে বসতেন। এ আড্ডাটা হতো মূলত আমিন সাহেব যখন ক্যাশে বসতেন। সে আড্ডার লোকগুলো ছিলেন ড. অনুপম সেন, জহিরুল ইসলাম ছুট্টু, চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকমণ্ডলি প্রমুখ। শুনেছি নাকি এখানে একসময় নিয়মিত আসতেন হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ রফিক, মুনতাসীর মামুনের মতো লেখক ও সাহিত্যিকগণ। পাশে ‘শুকতারা’ নামে আরও একটি বুকশপ ছিল। ওখানে পাজামাপাঞ্জাবি পরিহিত সাদা চুলের মানুষটার অবয়ব চোখে ভাসছে।

মোমিন রোডের কথাকলি ছিল আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা। বসার জায়গা ছিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতাম। পাঁচসাতজন কিংবা আরও বেশি। বই দেখতে দেখতে কিংবা বই নিয়ে আলোচনা করতে করতে ভেসে যেতাম। তাপস, তপনরা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতেন। কথাকলি’র তিনজন স্টাফ ছিল। তাঁদের সঙ্গে আমাদের খুব সখ্যতা ছিল। তপন ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি আহসানউল্লাহর ভাইপো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক ১৯৮১ সালে কথাকলি প্রতিষ্ঠা করেন। কথাকলি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বুকশপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের উপস্থিতি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। বিভিন্ন সংগঠনে ভর্তি, প্রতিযোগিতার ফর্ম, নাটকের টিকিট ইত্যাদির জন্য কথাকলি ছিল অপরিহার্য ঠিকানা। কথাকলি এসব কারণেও প্রগতিশীল লেখকসাংস্কৃতিক তারুণ্যের মিলনস্থান ছিল। সত্যেন সেন রচনাবলী বিক্রির সময়ে এঁদের যাতায়াত বেড়ে যায়। প্রকাশক প্রকাশপূর্ব বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল। চট্টগ্রামের দায়িত্ব পেয়েছিল কথাকলি। নিউমার্কেটে চারটি বুকশপ ছিল। নিচতলায় ছিল দ’ুটিএকটি উজালা বুক সেন্টার, অপরটি নিউজফ্রন্ট। নিউজফ্রন্টের মালিক ছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের মালিক ইউসুফ চৌধুরী। তিনি বিখ্যাত ‘সিগনেট প্রেস’রও মালিক ছিলেন। বাংলাদেশে ‘রিডার ডাইজেস্ট’ পত্রিকার পরিবেশক ছিল ‘নিউজফ্রট’। উজালায় যেতাম ভারতীয় বইয়ের সন্ধানে। নিউমার্কেটের দোতালায় সিঁড়ির সামনে ছিল ‘বইঘর’। সৈয়দ মোহাম্মদ শফি ১৯৬০ সালে বইঘর প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বাংলার অন্যতম সেরা প্রকাশনা সংস্থা ছিল ‘বইঘর’। বইঘর থেকে বঙ্কিম রচনাবলী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, এখলাস উদ্দিন, পুর্ণেন্দু পত্রী, লীলা মজুমদারের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোর প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন খালেদ চৌধুরী, পুর্ণেন্দু পত্রী, কাইয়ূম চৌধুরীর মতো নন্দিতশিল্পীরা। এঁদের বইয়ের সন্ধানে বইঘরে যেতাম। বইঘরের অতীতের সেই জৌলুস আমরা দেখেনি। ১৯২৬ সালে শফি সাহেবের পিতা নূরুল আলম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দ্য আর্ট প্রেস’। শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে কোতয়ালীর মোড়ে এখনও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। নিউমাকের্টের চারতলায় ছিল মনীষা লাইব্রেরি। চাইনিজ বইয়ের জন্য এটা বিখ্যাত ছিল। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ছিল চলন্তিকা ঘর ও পিপলস বুক। ডিসি হিলের উল্টো দিকে ডিরোজিও নামে একটি বুকশপ ছিল। লালদিঘির পশ্চিম পাড়, নিউমার্কেট এবং আরও নানান স্থানের ফুটপাতে তখন নতুন পুরাতন বই পাওয়া যেত। অনেক রাজনীতিবিদকেও দেখেছি বই কিনতে। প্রয়াত আতাউর রহমান কায়সার আসতেন। কত নাম জানা, অজানা মানুষ আসতেন। বই কিনতেন, বই দেখতেন। গাড়ি থামিয়ে ঢুকে যেতেন বুকশপগুলোতে।

পুরাতন বই বিক্রি ও ভাড়া দেওয়ার দোকান ছিল। স্টেশন রোডের নূপুর মার্কেটের অমর বইঘর পুরাতন বইয়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। গলির মতো ছোট্ট দোকানটিতে আমার কাকা অধ্যাপক সরোজ বলের সঙ্গে প্রথম গিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত পুরাতন বইয়ের দোকান ‘অমর বইঘর’এ অনেক দুর্লভ বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। অনুসন্ধানী পাঠকমাত্রেই ওখানে যেতেন। এটার মালিক ছিলেন মো. আবুল হোসেন। স্টেশন রোডে আরও একটি পুরাতন বইয়ের দোকান ছিল। রাইফেল ক্লাবের উল্টোদিকে পুরাতন বইয়ের একটি ছোট্ট বুকশপ ছিল। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মাকসুদের মাধ্যমে শশ্মুমন্ডিত মালিকের সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি বই ভাড়া দিতেন আর সহযোদ্ধাদের খবর আদানপ্রদান করতেন। মাসুদরানা, দস্যুবনহুর, রোমেনা আফাজের বই ভাড়া দিতেন। দু’একবার ভাড়া এনেছি। ভাড়া নিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল না। ফেরত দেওয়ার চিন্তায় পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারতাম না। তাই কম যেতাম। এসব এখন গল্পকথা। দূরের শোনা গল্প।

অবসরে যাওয়ার মতো জায়গা না থাকলে বুকশপগুলোতে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে দিতাম। আমার কাকার কাছ থেকে বুকশপে ঘোরাঘুরি আর বইকেনার নেশাটা পেয়েছি। একবার কাকিমা পূজার শার্ট কেনার টাকা দিয়েছিলেন। নিউমার্কেটে শার্ট কিনতে গিয়ে বই কিনে ফিরেছিলাম। শার্ট কেনার জন্য এরপর আর টাকা দেননি। ছাত্রাবস্থায় টিফিনের টাকা, হাতখরচা বাঁচিয়ে বই কিনতাম। নিজে পড়েছি, অন্যকে পড়তে দিয়েছি। চট্টগ্রামের এক প্রবীণ নিয়েছিলেন কবি মিনার মনসুরের নিষিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্র’। ঢাকাতে অন্য একজন সৈয়দ জামিল আহমেদের একটি বই নিলেন। বই দু’টি ফেরত পাইনি। মনে পড়লে আজও মন খারাপ হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধনিজে বাঁচতে হলে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে