পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের অংশ নিয়ে কারা খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানাতে চায় তা জনগণের সামনে পরিষ্কার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মারাত্মক একটা চক্রান্তের কথা বলেছেন। চক্রান্তটা কী, কোনো একটা শক্তি বাংলাদেশের একটা অঞ্চল তথা চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের একটা অংশ নিয়ে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চায়, নতুন একটা খ্রিস্টান ভূ–খণ্ড তৈরি করতে চায়। ভয়াবহ। আমার দেশের অংশকে নিয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্র অন্যকিছু করতে চায়। আর আমি শুধু বসে বসে কথাই বলব, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেব না? আমরা জানতে চাই, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) পরিষ্কার করে জনগণের সামনে বলবেন, কারা চায়, কেন চায় এবং কীভাবে চায়? শুধু বললেই তো হবে না, জনগণকে সেজন্য অবশ্য তৈরি করতে হবে। কিন্তু তার সে শক্তি নেই। তিনি তো তামাশার খেলা খেলে খেলে ক্ষমতায় এসে গেছেন। একবার এর সঙ্গে, আরেকবার ওর সঙ্গে ভাব, এই টিকে আছেন। কিন্তু এইভাবে টিকে থাকা যায় না।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘জাতিসত্তার রূপকার : রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ফখরুল।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ মে রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মত খ্রিস্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে’ বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন। মির্জা ফখরুল পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে বাঁচাতে সরকার গোপনে দেশের বাইরে ‘পাচার’ করে দিয়েছে বলেও দাবি করেন। বলেন, বলতে লজ্জা হয়। আমাদের পুলিশ ও র্যাবের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ, তার বিরুদ্ধে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় পাতায় হাজার হাজার দুর্নীতির খবর বের হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে এমন একটা জায়গা নেই যেখানে সে জায়গা কিনেনি, দখল করেনি। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গা পর্যন্ত জোর করে দখল করে নিয়েছে। আর এই সরকার কি করছে? ওই চোরকে, ওই ডাকাতকে বাঁচাবার জন্যে গোপনে পাচার করে দিয়েছে।
ফখরুল বলেন, আমার সেনাবাহিনী, যার উপর আমরা সবচাইতে ভরসা করি। যাদের ওপর মানুষের বেশি আস্থা রয়েছে আজ সে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধানের ওপর মার্কিন স্যাংশন আসে। মার্কিন স্যাংশনে বলে দেওয়া হয় কি কি কারণে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে দুর্নীতি প্রধান। দ্বিতীয়ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে বাধা দেওয়া। এগুলো তারা (সরকার) তৈরি করেছে। একটা আজিজ নয়, একটা বেনজীর নয়, এরকম অসংখ্য বেনজীর ও আজিজ আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে। চতুর্দিকে দেখবেন আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট সব একেকটা রাক্ষস হয়ে উঠেছে। মাফিয়া চক্র তৈরি করেছে। পুরো দেশটাকে তারা গিলে খাচ্ছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে নাগরিক সমাজের সংগঠন ‘চট্টগ্রাম ফোরাম’ এর উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে এতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী। নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, এস এম ফজলুল হক, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ। ড্যাবের কেন্দ্রীয় সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. এস এম সারোয়ার আলমের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর ও চট্টগ্রাম ফোরামের আহ্বায়ক একরামুল করিম।
আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানকে ছোট করে দেখাতে চায় দাবি করে ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ার পরে প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাকশাল বাতিল করে দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এগুলো বাস্তবতা, এসব বললে কেউ আওয়ামী লীগের গা জ্বলে যায়। জিয়াউর রহমানকে গালিগালাজ করে, তাকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলে এবং তাকে ছোট করে দেখাতে চাই। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনো ছোট করিনি। আমরা অন্যান্য যে জাতীয় নেতারা আছেন, ১৯৪৭ সালের আগে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন তাদেরকে স্মরণ করতে চায়, তাদের কথা বলি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা চায় না। একজন ভদ্র মানুষ (শেখ মুজিবুর রহমান) তাদের কাছে সব।
তিনি বলেন, মাল্টিপাটি ডেমোক্রেসি আওয়ামী লীগ চায়নি। তারা সবসময় চেয়েছে তারা নিজেরাই একাই সবসময়ই দেশ শাসন করবে, আর কেউ করবে না। তারা লুটপাট করবে, সবকিছু তারাই নিয়ে যাবে এবং করেছেও তাই। আওয়ামী লীগই প্রথম সংবিধান কাটাছেঁড়া করে নষ্ট করেছে। প্রথমে তারা বিশেষ ক্ষমতা আইন করেছে। এরপর জরুরি অবস্থা আইন করেছে। সবশেষে যখন সামাল দিতে পারছিল না তখন সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন তথা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিল।
ফখরুল বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। তার নেতৃত্বে মাত্র ১১ দিনের পার্লামেন্টের একটি সভায় সেদিন গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল তৈরি করা হয়। এই বাকশাল ছিল বাংলাদেশের মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে। বাকশাল তৈরি করে তারা সমস্ত জাতিকে শৃঙ্খলিত করে ফেললেন। কারো কোনো ভিন্নমত থাকতে পারবে না। এক নেতার এক দেশ। আজকে সেই আওয়ামী লীগ আবারও নতুন করে সেই বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার জন্যে গত ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু নতুন এবং সম্ভাবনাময় সবকিছুর সূচনা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের উন্নয়নের শুরুটা করেছিলেন তিনি।
ফখরুল বলেন, আজকে যে শাসন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এরা সবসময় গণতন্ত্র বিরোধী, এরা সবসময় একনায়কত্বে বিশ্বাস করে এবং তারা ওই বাকশালই বিশ্বাস করে। তারা বাকশাল তৈরি করতে চায়, নতুন ষড়যন্ত্র করে গণতন্ত্রে একটা ফ্যাসাদ দিতে চায়। সেভাবে তারা ওই শাসনকে আবার নিয়ে আসতে চায়। এজন্য ১৫ বছর ধরে সবসময় বেআইনিভাবে, বিনা ভোটে জনগণের সমর্থন ছাড়াই রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখল করে আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে শর্তগুলো ছিল, সবগুলো খানখান করে দিয়ে কিছু দল ব্যক্তিকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে লুপাটের সুযোগ করে দিয়েছে। এদেশে তারা লুটের আর চুরির রাজত্ব তৈরি করেছে।
ফখরুল বলেন, জাতির নতুন আইডেনটিটি বা পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ কারণে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের চর ছিলেন, যুদ্ধ করেননি বলে অপপ্রচার চালায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন আক্রমণ করল, সবাই পালিয়ে ছিলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন ছিল একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আর এরা আমাদেরকে দিচ্ছে দুর্নীতি, মাফিয়া যুক্ত, আইনের শাসনকে শেষ করে দিয়ে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে ডামি নির্বাচন আর মধ্যরাতের নির্বাচন– এসব দিচ্ছে। মানুষ এসব বেশিদিন সহ্য করবে না। মানুষ প্রতিবাদ, লড়াই ও সংগ্রাম করছে আরও করবে। আপনারা চট্টগ্রামের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করছেন, ১৫ বছর ধরে ভয়ানক দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।
ধারণাপত্রে কাদের গণি চৌধুরী বলেন, জিয়াউর রহমান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এদেশের সমৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার সততা ও দেশপ্রেম ছিল সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। তার সততা নিয়ে তার চরম শত্রুও কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। সেদিন রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতার কারণে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ৭১ ও ৭৫ সালে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। পাহাড়ি ও বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, আবার চট্টগ্রামের মাটিতে শাহাদাত বরণ করেছেন।
এস এম ফজলুল হক বলেন, জিয়াউর রহমানের শুরু এবং শেষও চট্টগ্রামে। তিনি রাজনীতিকে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। কৃষক শ্রমিকের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজকে ইতিহাস থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনোদিন সম্ভব হবে না।
মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, শহীদ জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলেই আমরা একটি মানচিত্র পেয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই মানচিত্র এখন গিলে খাচ্ছে। তারা ভোট ডাকাতির মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। তাই আমাদেরকে শপথ নিতে হবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার। আজকে জিয়া পরিবারের উত্তরাধিকারী তারেক রহমানের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই সরকারের পতন না হবে আমরা কেউ ঘরে ফিরে যাবো না।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ২৫ মার্চের কালোরাত্রিতে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে জিয়াউর রহমান ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানে পাক বাহীনির বিরুদ্ধে উই রিভোল্ট বলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি গার্মেন্টস সেক্টরের উদ্ভব ঘটিয়েছেন। বিদেশে কর্মসংস্থাানের ব্যবস্থা করেছন। তিনি বাংলাদেশের গতি সঞ্চারিত করেছিলেন। তাই শহীদ জিয়াকে বাদ দিয়ে এদেশে কোনো ইতিহাস রচিত হতে পারে না।
সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেতা এ এম নাজিম উদ্দীন, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, দিপেন দেওয়ান, কর্নেল মনিষ দেওয়ান, শাহজাহান চৌধুরী, সাচিং প্রু জেরী, হুম্মাম কাদের চৌধুরী, আবু সুফিয়ান, এনামুল হক এনাম, জাবেদ রেজা, মামুনুর রশীদ মামুন, পেশাজীবী নেতা জাহিদুল করিম কচি, ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. তমিজ উদ্দিন আহমেদ মানিক, এড. এনামুল হক, এড. মফিজুল হক ভূঁইয়া, অধ্যাপক ড. নসরুল কদির, মো. শাহনওয়াজ, ইঞ্জিনিয়ার জানে আলম সেলিম, সালেহ নোমান ও এমদাদুল হক চৌধুরী।