সেই ষাটের দশকের আমাদের ছেলেবেলা আমাদের কৈশোর। তখন বাংলাদেশের কোনো গ্রামে বা বড় কোনো প্রসিদ্ধ থানা যেমন আমাদের হাটহাজারি বা কুমিল্লা লাকসামে কোনো বৈদ্যুতিক বাতি ছিলো না। গ্রামে ছিলো হাত পাখার প্রচলন। রাত্রিতে দাদীর সাথে যখন বিছানায় যেতাম তিনি হাত পাখা দিয়ে আমাদের বাতাস করতেন। সে সময় চট্টগ্রাম হালদা নদীর উপকণ্ঠে আমাদের গ্রামে বড় বড় মান্দার গাছ এবং সেখানে লাল লাল ফুল ফুটতো। আমাদের সামনের পুকুর আমাদের বড় পুকুরে তিনটি শিমুল গাছ ছিল। অনেক উচ্চ ছিল গাছগুলো। বড় পুকুরে কবরস্থান ছিল দুটি উচ্চ লম্বা শিমুল গাছ। সেই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে শিমুল গাছ লাল ফুলে ভরে যেত আর তার ডালপালা অপূর্ব শোভা বর্ধন করত। দুপুরে আমাদের ঘুমানোর জন্য দাদী আম্মারা ছেলে ধরা বা গলাকাটা ভয় দেখাতো। দুপুরে ওরা এসে একা পেলে ছেলেপেলেদের ধরে নিয়ে যায়। শুক্রবার জুমার দিনে লাইন ধরে ভিক্ষুক ভিখারি আমাদের বাড়ির উঠানে এসে ভিক্ষা এবং বিশ্রাম নিত।
গ্রীষ্মের রাত্রে যখন পূর্ণিমা থাকতো তখন বাড়ির উঠানে আমাদের পাটি বিছিয়ে দেওয়া হতো, ওখানে বালিশ নিয়ে খোলা আকাশের চাঁদ দেখে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে আমাদের জ্যাঠা লাল মিয়ার বাড়ি, তাদের কনিষ্ঠ ছেলে জাফরুল্লাহ আমার খেলার সাথী ছিল। তাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটি বড় নালা ছিল যেখানে সমস্ত বাড়ির পানি দিয়ে চলে যেত এবং সেটা হালদা নদীতে গিয়ে পড়েছে। ওটা দিয়ে জোয়ার ভাটার পানি আসতো আমাদের বাড়ির কাছেই। সেই দক্ষিণ ভিটা ছিল কলা বাগান সেখানে মাদুর পেতে নদীর খোলা হাওয়ায় আমরা দুপুরটা কাটিয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে লাল পিপড়া এসে কামড় দিত, লাল হয়ে ফুলে উঠতো, আমাদের বোনেরা তাতে থুথুু লাগিয়ে দিতেন।
মাঝে মাঝে হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে রাস্তার ধুলবালি গাছের পাতা মান্দার ফুল উড়িয়ে নিয়ে একপ্রকার দৌড় দিত, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাকে টুইত্তা বয়ার বলতো হঠাৎ করে ছুটে আসা বাতাস। সামনের উঠানে সে সময় পাখিদের ময়না পাখি, শালিক, দুপুরে আমাদের পাক ঘরের পিছনের গাছে বড় ঘুঘু পাখিদের একটানা তাদের ডাক একটি মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতো। দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক চমৎকার ছিল। ৭০ দশকে ইয়ার গান বন্ধুক দিয়ে পাখি শিকার করায় গ্রাম অঞ্চলে সমস্ত পাখি চলে গেছে। শুধুমাত্র কাক পাখি ব্যতীত। পুকুরে যখন মাছ ধরত কোথা থেকে গাং চিল উড়ে পুকুরে টুপ ছো মেরে মাছ ধরে নিয়ে যেত, এখন সে গাংচিল আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম দেখবে না চিনবেও না।
সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল গ্রাম অঞ্চলে দুপুরে আইসক্রিম ওয়ালা। পিছনে যা বড় একটা বাক্স নিয়ে ডাক দিতো আইসক্রিম। লাল এবং হলুদ রঙের আইসক্রিম মধ্যখানে একটি বাঁশের কঞ্চি ওখানে আইসক্রিম ধরে আমরা খেতাম। গ্রামের মেয়েরা সেই আইসক্রিম ভেঙে তো মাথায় দিত, আর সেকি উৎসব। মাত্র দুই পয়সা দাম আইসক্রিমের। আস্তে আস্তে স্কুল, কলেজে গেলাম, কোনো কোনো গ্রামে বৈদ্যুতিক বাতি আসেনি। আমাদের গ্রামে টিনের ঘর, রাত্রে শীত প্রচণ্ড গরমে আমাদের পড়তে কষ্ট হতো। তখন বাড়ির উঠানে পড়ার টেবিল নিয়ে হারিকেন নিয়ে পড়তে বসতাম।
গ্রামের সেই সময় বাজারে বাঙ্গি ও তরমুজ এর মৌসুম। কালাচাঁদ চৌধুরীর হাট রবিবার এবং বুধবারে মিলতো। বাজার থেকে আসার সময় সবার হাতে বড় বড় বাঙ্গি দেখা যেত। আর হালদা নদীর গড়দুয়ারা চরে খিরা খেত। আমরা মাঝে মাঝে নৌকা দিয়ে সেগুলি নিয়ে আসতাম। অনেক খিরা শসা ফলন হতো। অনেক সময় বিনামূল্যে দিয়ে দিত। গ্রীষ্মের দুপুর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত যখন দেখতাম আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমকানো। হালদা নদীর পাড়ে গভীর রাত্রে মানুষের চিৎকার মাছের পোনা ছেড়েছে, সমবেত চিৎকার আনন্দ উল্লাস রাত্রি নীরবতা মাঝে মাঝে খান খান হয়ে যেত। হঠাৎ ঝুপঝাপ বৃষ্টি, টিনের ছাদে তার শব্দ, সমস্ত পানি বাড়ির উঠানের না পড়ার জন্য টিনের চোঙ্গা দিয়ে দিতো যাতে সমস্ত পানি একদিকে পড়ে। আমার মা দাদি সেই পানি বালতি বা কলসিতে নিয়ে আসতো। সবচেয়ে আনন্দদায়ক ছিল আমাদের সামনের পুকুরে বড় বড় আম গাছ ছিল, তার নিচে বসে ঝিনুক দিয়ে কাঁচা আম খাওয়া ছেলেমেয়ে সবাই মিলে। বড় আম গাছ আর নেই। আমাদের ছেলেবেলায় বড় দুইটি ঘূর্ণিঝড় আমরা দেখেছি, শুনেছি পতেঙ্গায় সমুদ্র ঢেউয়ে মানুষ মারা যাওয়া। বড় বড় মান্দার গাছগুলো সে সময় পড়ে গিয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরে দক্ষিণ পারে দুটি বড় জোড়া কাঁঠাল গাছ ছিল, তাদের বড় বড় শিখর উপরের নিচের দিকে নেমে গেছে। আমি কাঁঠাল গাছের শিকড়ে বসে বরশি দিয়ে মাছ ধরতাম।
দক্ষিণের বাতাস সেই পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি, আমার মনে হতো আমি একটা জাহাজে বসে আছি, পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কুচুরিপানার উপর ছোট ছোট মাকড়সার দৌড় সাঁ করে চলে যেত পুকুরের উপর ছোট ছোট বিন্দু সৃষ্টি করে। পুকুরের পাশে ছিল কেয়া গাছের ঝোপ তার ভিতরে শান্ত হারকিরি পাখি দেখা যেত। দাদিরা বলতো তার সন্তান অকালে মারা যাওয়ায় সে এমন শান্ত। মাঝে মাঝে বড় গুইসাপ দেখা যেত। সাঁ করে পুকুরের এপার থেকে ওপারে চলে যেত। আজ আর কিছু নেই। একটু ছোট যন্ত্রের মধ্যে আমাদের ছেলেমেয়েরা আবদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের পৃথিবী ছিল বিরাট আর তাদের পৃথিবী ছোট একটি মোবাইলের ভিতর। মাঝে মাঝে আকাশে উড়োজাহাজ দেখা দিত। সেই জাহাজ দেখার জন্য আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, দেখতাম কেমন করে মেঘের ভিতর উড়োজাহাজ ঢুকে গেল। বড় আকাশটা ছিল আমাদের কল্পনার ঠিকানা। এখনো মাঝে মাঝে সেই ঠিকানা খুঁজে বেড়ায়। সাত সাগরের তেরো নদীর পাড়ে দেখে এলাম তারে। সে দেখার মধ্যে আমাদের আনন্দ আমাদের স্মৃতি বেঁচে থাক চিরদিন চিরকাল।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, প্রাক্তন সহ–সভাপতি, চট্টগ্রাম সমিতি–ঢাকা, বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।