চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যু কিংবা ভুল চিকিৎসার পরিণতিতে মৃত্যুর অগুনিত খবর আসে পত্রিকা অফিসে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত এক বছর ধরে এমন মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে– যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁরা বলছেন, ‘অবশ্যই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপারেশন ও চিকিৎসাসেবায় ত্রুটি আছে এবং এর কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে। নইলে দেশের চিকিৎসাসেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, রোগীরা বিদেশমুখী হয়েছে, আরো বেশি হবে। কতিপয় চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও অবহেলায় রোগীর মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়।’ এদিকে ভুল চিকিৎসায় অহরহ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত টিম গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অজ্ঞানকারী ওষুধের কারণ, চিকিৎসকদের গাফিলতি, নাকি অন্য কোনো কারণ তা অবশ্যই অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ফজলে এলাহী খাঁন তাঁর এক লেখায় বলেছেন, বিদ্যমান জনবল, অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম সব মিলিয়ে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি চিকিৎসাসেবা যেমন চালু রয়েছে, তেমনিভাবে বেসরকারি পর্যায়ের এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মনোবৃত্তি থাকা বাধ্যতামূলক। মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করাও জরুরি। সরকারের বিদ্যমান নিয়মনীতি মেনেই স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা করতে হবে। যদি তা মান্য করা না হয় তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক অনুমোদন দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করছে কি না, আইসিইউ আছে কি না, গাইডলাইন অনুসরণ করছে কি না– তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। এটা হয় না বলেই ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে–সেখানে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যদি সব ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তারা অপারেশন করতে পারবে না। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর হার হ্রাস পাবে।
চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর প্রতি অবহেলা করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পেশাগত দক্ষতা প্রয়োগ করেই তাঁরা সাধারণত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার পরও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার জন্য চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে দায়ী করার সুযোগ নেই। অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনে একই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক যদি চিকিৎসায় অবহেলা হয়নি–এমন মতামত দেন, তাহলে সে মামলা থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসক সহজেই অব্যাহতি পেয়ে যাবেন–এমন মন্তব্য করেছেন আইনজীবী বাহাউদ্দিন আল ইমরান।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেছেন, চিকিৎসাসেবা পাওয়া জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। তাই পথঘাটের ছিন্নমূল মানুষ থেকে শুরু করে শত কোটি টাকার মালিক–সবার জন্যই যথাযথ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের আয় সীমিত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের একজনও যেন বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় না নেয়, তা নিশ্চিত করার দায় আমাদেরই। এ বিষয়টা উপলব্ধি করে তা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। শুধু সরকার অথবা ডাক্তার নয়, প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ফার্মেসি, চিকিৎসা সহকারী, নার্স, থেরাপিস্ট সকলের সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমেই চিকিৎসা সেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত আধুনিকায়ন হলেও রোগীদের আস্থা বাড়েনি। ভুল রোগ নিরীক্ষা, বিশেষায়িত চিকিৎসা না পাওয়া, প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। অথচ বছরে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে যে খরচ হচ্ছে তার ২৪ শতাংশই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে ব্যয় করছে রোগীরা। দেশে চিকিৎসা ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেলেও রক্ষা হচ্ছে না রোগীর অধিকার। যেভাবেই হোক চিকিৎসা–ব্যয়ও কমাতে হবে। তাঁরা বলেন, চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর হার কমাতে এবং শতভাগ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষের উচিত দেশের প্রতিটি হাসপাতালে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা, চিকিৎসকদের সব সুবিধা নিশ্চিত করে রোগীদের যথাযথ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা।