‘দাদু রাজাকার কাকে বলে?’
মেঘের প্রশ্নে পত্রিকা থেকে চোখ ফিরিয়ে দাদু বললেন, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’
মেঘ বলল, ‘হঠাৎ না, কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করব। বইতে পড়েছি তো। আমার বন্ধুরা বলেছে, তুমিই ভালো জানবে কারণ তুমি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে দাদু?’
পত্রিকাটি একদিকে ভাঁজ করে রাখতে রাখতে মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের বললেন, ‘বসো তাহলে।‘
তাহের সাহেবের বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ১১/১২ বছর হয়ে গেল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে বড় ছেলের সঙ্গেই থাকেন। পত্রিকা পড়া, টিভি দেখা আর ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া কিশোরী নাতনি মেঘের সঙ্গে গল্প করে করে দিন তাঁর ভালোই কাটে। বিশেষ করে নাতনী হোক বা যে কেউ হোক, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর আগ্রহের সীমা থাকে না। আজও তেমনি, বলার সুযোগ পেয়ে খুশিতে নাতনিকে শোনাতে চান কিছু।
একটু আয়েশ করে বসে বললেন, ‘বলো এবার কী জানতে চাও?
‘জানতে চাইছি দাদু, রাজাকার কাদের বলে, তুমি কি দেখেছো তাদের?’
‘দেখিনি মানে? ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। বিজয়ের পরে ওদেরকে ধরে এনে পিটিয়েছি। আমাদের এলাকার কুখ্যাত রাজাকার ছিল আসকর আলী। শোনো তবে সেই রাজাকারের কথা বলি।‘
বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন যেন তিনি।
‘তোমরা না পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো, তো আবার রাজাকার আসলো কোথা থেকে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মেঘ।
‘শোনো, যুদ্ধ তো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধেই করেছি। ওরা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। আর রাজাকার হচ্ছে এ দেশের বাঙালি যারা পাকিস্তানিদের পক্ষ হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।‘
দাদুকে থামিয়ে দিয়ে মেঘ বলে, ‘ওরা বাঙালি হয়ে কেন বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?’
‘তাহলে আমাকে বলতে দাও।‘ নাতনিকে থামিয়ে দিলেন দাদু।
‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি মিলিটারিরা যখন ঢাকাসহ সারাদেশে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। তারা সারাদেশে বাঙালিদের হত্যা করতে থাকে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। বিশেষ করে যারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করতো তারা। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ভারতে চলে যেতে থাকে। এভাবে প্রায় এককোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। আমাদের সমবয়সীদের অনেকে ভারতে চলে যায়। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করে। এরমধ্যে অনেকে ভারতে যেতে না পারলেও এখানে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করেছে। অনেকে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে পাকিস্তানিদের পক্ষে থেকে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।‘
‘ওদেরকেই কি রাজাকার বলা হয়?’ প্রশ্ন করে মেঘ।
‘একদম ঠিক বলেছো‘ দাদুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যারা শুরু থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানিরা তিনটি বাহিনী গঠন করেছিল, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। যাদের কাজ ছিল পাকিস্তানিদের হয়ে এ দেশের স্বাধীনতাকামী অর্থাৎ যারা স্বাধীনতা চায় তাদের হত্যা করা নতুবা পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে তুলে দেওয়া।‘
‘কী বলো দাদু ওরাও বাঙালি না, বাঙালি হয়ে কেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে না?’
‘সেটাই তো কথা।‘ দাদু মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানিরা এ দেশের পথঘাট চিনতো না। রাজাকারসহ আর দুই বাহিনীর সদস্যরা হিন্দুদের বাড়ি, দোকানপাট এবং আওয়ামী লীগের নেতাসহ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তাঁদের বাড়ি চিনিয়ে দিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।‘
শুনতে শুনতে মেঘের খুব কান্না পায়। রাজাকারদের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণা হয় তার।
তার আনমনাভাব লক্ষ্য করে দাদু বলেন, ‘তোমার কি খুব মন খারাপ হচ্ছে। তাহলে আজ থাক। আরেকদিন বাকিটুকু বলবো।‘
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না না দাদু, তুমি বলো। আমি শুনতে চাই।‘ একটু দম নিয়ে আবার বলল, ‘এমন রাজাকার তুমি দেখেছো? তুমি তো দাদু মুক্তিযোদ্ধা ছিলে, বিজয়ের পরে তাদেরকে কোনো শাস্তি দাওনি?’
‘দিয়েছি না! আমাদের এলাকার কুখ্যাত রাজাকার ছিল আসকর আলী। রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে সে নাম পরিবর্তন করে রাখে আলী আসকর চৌধুরী। কারণ আমাদের এলাকার চৌধুরী পরিবারের বড় দাপট ছিল। সেও চৌধুরী লিখে একটু জাতে ওঠার চেষ্টা করেছিল। আমাদের বাজারে এক হিন্দু ব্যবসায়ীর মস্ত দোকান ছিল। যুদ্ধ শুরু হতেই আসকর আলীরা সে দোকান লুট করে। পরে দখল করে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। তার ভয়ে আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের বহু গ্রামের মানুষ আতঙ্কে থাকতো। মনে করো সে কোথাও যাওয়ার পথে কারো গরু বা ছাগল দেখতে পেলো মাঠে। তার ইচ্ছে হলে তা ধরে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলতো। অথবা কোনো গৃহস্থকে বলতো, কয়েকটা মুরগি পাঠিয়ে দিতে ক্যাম্পে। না দিলে রাজাকারেরা এসে অত্যাচার করতো।
আমাদের গ্রামে দুটো হিন্দুবাড়ি ছিল। যুদ্ধ শুরু হতেই সে দু বাড়ির কিছু বয়স্ক নারী–পুরুষ ছাড়া বাকি সবাই ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। হিন্দুবাড়ি দুটো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে চিনিয়ে দিয়েছিল সে। পাকিস্তানিরা ওই বয়স্ক নরনারীদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করেছিল-‘
‘ব্রাশফায়ার কী দাদু?’
স্টেনগান নামে অস্ত্র ছিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে। ওটা দিয়ে একনাগাড়ে গুলি করা যায়। একনাগাড়ে গুলি করাকে ব্রাশফায়ার বলে।‘
ছোট্ট করে বলল মেঘ, ‘ও আচ্ছা‘
‘তো‘ আবার শুরু করেন দাদু, ‘গুলিতে যারা মরেননি তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে আসকর আলী রাজাকার।‘
‘বেয়নেট কী দাদু?’ খুব আগ্রহ নিয়ে জানত চায় মেঘ।
‘বেয়নেট হচ্ছে একপ্রকার ছুরি যা রাইফেলের মাথায় লাগানো থাকে। তারপর সে এবং তার সঙ্গী রাজাকার ও কিছু গ্রামবাসী মিলে সে বাড়িগুলো লুট করে সবকিছু নিয়ে যায়।
‘কী বলো এভাবে মেরেছে?’ মেঘ আর সহ্য করতে পারে না। ডুকরে কেঁদে উঠে দাদুকে জড়িয়ে ধরে সে। তার সঙ্গে দাদুও কাঁদতে থাকেন।
অনেকক্ষণ পর একটু স্বাভাবিক হয় মেঘ। চোখ মুছতে মুছতে বলে, ওই রাজাকারটিকে কোনো শাস্তি দাওনি তোমরা?’
‘দিয়েছি না! ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার পর সারা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনারা চোরের মতো পালিয়ে ঢাকার দিকে যেতে থাকে। আর তাদের সাহায্যকারী রাজাকার–আলবদররা এদিক–ওদিক লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আসকর আলী পালাতে পারে না। তার ওপর সবাই খুব ক্ষিপ্ত ছিল। একদিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর সে জনতার হাতে ধরা পরে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরার আগে জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল তাকে।‘
‘তাহলে তোমরা এখনও যে রাজাকার, রাজাকার করো ওরা আসলো কোথা থেকে।‘
‘সব রাজাকার তো মারা পড়েনি, ওরা এখনও বেঁচে আছে। তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও আছে, একাত্তরেই যে শুধু রাজাকার ছিল তা নয়। এখনও রাজাকার আছে আমাদের চারপাশে। বয়স যাই হোক, যারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করে তারাই রাজাকার। কাজেই এক আলী আসকর রাজাকারের মৃত্যু হলেও সমাজে এখনও অনেক রাজাকার আলী আসকর রয়ে গেছে। তোমরা বড় হলে নতুন রাজাকারদের অবশ্যই প্রতিহত করবে।
মেঘ বললো, ‘তুমি দোয়া করো দাদু।‘