মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অব্যাহত হস্তক্ষেপের কারণে গত ৭৭ বছরে পাকিস্তানি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। ইমরান খানের ঘটনা তার সর্বশেষ উদাহরণ। বস্তুত সামরিক বাহিনী নামে বেনামে প্রথম থেকে পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে উঠে। অর্থনীতিতে গড়ে উঠে শক্তিশালী বাইশ পরিবারের একচেটিয়া আধিপত্য। পূর্ব পাকিস্তানকে পরিণত করা হয় শোষনের মৃগয়া ক্ষেত্রে। সব ক্ষেত্রে অধিকার হারা বাঙ্গালি ফুঁসে উঠে বার বার। ভাষা,ভাত ও ভোটের দাবিতে রক্তাক্ত হতে থাকে বাংলার মাটি। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের ধর্মের নামে শাসন শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই নয় মাসের গণহত্যা ও সশস্ত্র লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বার্থ ক্রাই ছিল গণতন্ত্র, রাজনীতির নামে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বৈষম্যহীন আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা তথা সমাজতন্ত্র। সময়ের দাবী অনুযায়ী সেই গণদাবী ও আকাঙ্ক্ষার উপর ভিত্তি করে দ্রুততার সাথে গৃহীত হল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিসারী একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সেই সংবিধান ছিল রক্তে ভেজা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনকে বাদ দিয়ে লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা সংবিধানের মর্মবস্তু, ও মানুষের প্রত্যাশা ও পরির্বতনের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করার মতো শক্তি ও প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে ছিলনা। ন্যাপ সিপিবি থেকে দাবী উঠেছিল নতুন দেশের নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতীয় সরকার গঠন করার কিন্তু তা মানা হয়নি। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনেও সীমিত কারচুপি হয়। বিরোধী দল বিশেষ করে ন্যাপকে কিছু তরুণ নেতাদের অতি উৎসাহে ১৫ থেকে ২০টি আসন থেকে বঞ্চিত করা হয় অন্যদিকে পরাজিত খুনি মুস্তাককে বিজয়ী দেখানো হয়। শাসক দলের মধ্যে দক্ষিণ পন্থী চক্রটি শক্তিশালী হয়ে উঠে। সার্বিক এক সংকটের দিকে দেশ এগোতে থাকে। ’৭৫ এর নির্মম হত্যাকান্ড ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বলতে গেলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। এই প্রতিবিপ্লবী পরিবর্তন ও বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারা আওয়ামী লীগের বিশাল অক্ষমতার প্রমাণ। ১৯৬৫ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত দশ বছরে নানামুখী তীব্র সংগ্রামে ও অপরিমেয় আত্মত্যাগের ফলে জাতি হিসাবে যে মনোজাগতিক অর্জন ও পরিবর্তন হয়েছিল সবগুলোই এক মুহূর্তে যেন হারিয়ে গেল। এই বিয়োগান্তক প্রতিবিপ্লবী পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়েই এবং ১৯৭২ সাল থেকে এর তীব্রতা ও গতিবেগ বাড়তে থাকে। বস্তুত ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি পরাজয়ের দিকে হাঁটতে থাকে। ২৫ মার্চ এর পর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দেশের স্বার্থে তাজউদ্দিন ভারতে গিয়ে রাজনৈতিক সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থী হন ও দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সভাপতির অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিজে তুলে নেন। একমাত্র মোশতাক ছাড়া সৈয়দ নজরুল সহ দলের সব সিনিয়র নেতা তাঁকে সহযোগিতা করেন। সব চাইতে সংকট সৃষ্টি করে তাজউদ্দিন বিরোধী শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে যুব–ছাত্র নেতৃবৃন্দ। ভারত সরকারের ও দলের অধিকাংশ নেতা ও সংসদ সদস্যের সমর্থনে তাজউদ্দিন শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের বিরোধিতা মোকাবেলা করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করেন তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল, ধৈর্য, অপরিমেয় ত্যাগ ও দেশপ্রেমের বিনিময়ে। পাকিস্তান আমলের মতো বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের নৈকট্য ও সমঝোতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে গড়ে তোলার সে সময়ের পরিস্থিতিতে একমাত্র গ্যারান্টি। কিন্তু শুরু হল বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির অপরিণামদর্শী অপচেষ্টা। এ অপচেষ্টায় শেখ মণির নেতৃত্বে একদিকে বঙ্গবন্ধুর স্বজনরা যেমন তৎপর হয় তেমনি মোস্তাক – তাহের ঠাকুররা দৃষ্টিকটূ স্তাবকতা সহ নানা কৌশলে এগিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তারাই সফল হন। নয় মাসের মরণ জয়ী সেই সংগ্রামের মূল পরিচালক তাজউদ্দিনের কাছ থেকে একবারের জন্যও কিছুই জানতে না চাওয়ার মধ্যেই তাজউদ্দিনের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বঙ্গবন্ধুকে আমরা দেখতে পাই।
এই বিচ্ছিন্নতাই দেশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তার সদ্য গৃহীত রক্তে ভেজা সংবিধানের মূল নীতি আদর্শ থেকে। কিছুদিনের মধ্যেই দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী শেখ মণি ও সিরাজুল আলমখান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন। নব গঠিত জাসদের অতি বিপ্লবী রোমান্টিক হঠকারিতার আড়ালে তদানীন্তন ছাত্রলীগের সবচেয়ে সাহসী, ত্যাগী ক্যাডারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশাল একটি অংশ সরকার বিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এ ছিল এক মারাত্মক ক্ষতি যা এড়ানো সম্ভব ছিল। সংবিধানে নিষিদ্ধ থাকলেও এ সময়ে নানা কায়দায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও অপপ্রচার শুরু হয়, দুর্নীতি ও পারমিট বাজির ফলে শাসক দলের এক শ্রেণির নেতার কারণে জনজীবনের সংকট তীব্র হতে শুরু হলো, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এসব নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে বিজয়ের মাত্র ১০ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালে অক্টোবরে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে দুর্গাপূজার মন্ডপ ভাঙচুর করল এবং সেই ঘটনার জন্য একজন লোককেও কোথাও গ্রেপ্তার হতে হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারী ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে গুলি চালিয়ে দুজন কর্মীকে হত্য করা হয়। আশংকা জনক পরিস্থিতির মোকাবেলায় দলের দক্ষিণপন্থীদের চাপে প্রগতিশীলদের সাথে কার্যকর কোন ঐক্য গড়ে উঠলনা। ভুট্টোর অবাঞ্চিত সফর ও ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষ পরাজিত শক্তিকে চাঙ্গা করে তুলে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে কিছু প্রগতিশীল কর্মসূচি নিয়ে একদল করলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মানুষ বিদ্বিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সরকার থেকে। উপায় না দেখে বঙ্গবন্ধু ঝুঁকি নিলেন। তখন তিনি প্রকৃত অর্থেই একা এবং তখনি চরম আঘাত এলো। সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশ চলে গেল প্রতিবিপ্লবী পাকিস্তানি ধারায়। হতাশা থেকে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানে জনগণের এক বিরাট অংশ গা ভাসিয়ে দিল। সংবিধানের চার মূল নীতি এক কলমের খোঁচায় বাতিল করে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় জেঁকে বসেন। সমস্ত প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দেয়া শুরু হয় ব্যাংক বীমা, কল কারখানা সহ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। আজকের সংকটের মূল কারণ নয়া উদারবাদী তথা লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতির মার্কিন প্রেসক্রিপশন বিনা বাক্য ব্যয়ে চালু করেন। সম্ভাব্য বিরোধিতার মুখে প্রথম বারের মতো স্বাধীন দেশে জিয়া সিপিবিকে নিষিদ্ধ করেন। এরশাদ এসে সামরিক শাসনের অধীনে ধর্মান্ধতা ও অর্থনৈতিক লুটপাটকে ক্ষমতা রক্ষা করার একমাত্র লক্ষ্য বলে স্থির করে নয় বছর ব্যাপী এক সাম্প্রদায়িক ও লুটেরা দুঃশাসন চালু করে দেশকে চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিত্রিুয়াশীলতার গহ্বরে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রধর্ম চালু করে ধর্মান্ধতাকে সামাজিকীকরণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। অবশেষে সর্বাত্মক ছাত্র গণআন্দোলনে এরশাদের পতন ঘটে। কিন্তু রেখে যায় চরম ভাবে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মান্ধ ও লুটেরাদের নিয়ন্ত্রিত এক বাংলাদেশ। সুস্থ সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ তলানিতে ঠেকে। বিপর্যস্ত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ঘোষিত হয় তিন জোটের রূপরেখা। কথা ছিল নির্বাচিত সরকার এই রূপরেখা অনুসরণ করে দেশ চালাবে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচিত জামাত সমর্থিত বিএনপি সরকার স্বাভাবিকভাবে সে দিকে পথ মাড়াল না। জিয়া এরশাদের পথেই সব কিছুই চলতে থাকে। এ জন্য প্রগতিশলীদের যে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়।
সামপ্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও লুটেরা অর্থনীতির দ্বারা ইতোমধ্যে পরিবর্তিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী পথে পরিচালিত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার কঠিন লড়াইকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে প্রধান রিরোধী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতার রাজনীতির জন্য যা যা করা দরকার তাই করার প্রকাশ্যে অঘোষিত সিদ্ধান্ত নেয়, শুরু করে দেয় ভারসাম্যের রাজনীতি। বদলে যেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ মনে–মননে, রাজনীতিতে, ভাবাদর্শে। এতে ১৯৬০, ’৭০ এমনকি ’৮০ দশকের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তির ধার ও ভার দুটোই হ্রাস পায়। তারেব জিয়ার অপরিণামদর্শী মদদে ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টের ঘটনা আওয়ামী লীগকে আরো নেতিবাচক দক্ষিণ পন্থার দিকে ঠেলে দেয়। ঐ ঘটনার পর থেকে একটা ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে, দুই বৃহৎ দলের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে, তৈরি হয়েছে এক নবতর সংকট ও অবিশ্বাস যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘশাসনেও নানাভাবে আক্রান্ত হয়ে অনিশ্চিত নিরাপত্তায় শংকিত আজ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, বেশুমার দুর্নীতি, জনজীবনের তীব্র সংকট, সাম্প্রতিক সময়ে একজন সংসদ সদস্যের হত্যাকাণ্ড সহ পর পর ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা সংকটের গভীরতাকে স্পষ্ট করে। সবমিলিয়ে এই পরিস্থিতি মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই শক্তিশালী করে। সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মান্ধ অপশক্তির যে বিস্তার, তৃণমূলে সাম্প্রদায়িকতার প্রাতিষ্ঠানিকতা, কয়েকটি পরিবারের একচেটিয়া ব্যবসার নামে কার্যত লুটপাট ও লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার ঐ শক্তিকেই শক্তিশালী করছে। এরশাদ আমলে ক্ষমতার একচেটিয়া সুবিধাভোগী কয়েকজন এখন এই সরকারের কেউ উপদেষ্টা কেউ পরিচালক।
মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণের সহজ ও কার্যকর পন্থা যে জিয়া এরশাদ আমলে অকার্যকর করে দেয়া টিসিবিকে শক্তিশালী করে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে কয়েকজন ব্যক্তির একচেটিয়া প্রভাব কমিয়ে সরকারের পণ্য মজুদ বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা তা সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বুঝেন না এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। সিন্ডিকেট বাজির দৌরাত্ম্য বন্ধ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা এদের নেই। বস্তুত ’৭৫ পূর্ব সংকট সামরিক শাসনের প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারায় গভীর হয়ে গত দেড় দশকে বদলে যাওয়া শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্নবায়িত ও গভীরতর রূপে আজ জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। সংকটের কালান্তর ঘটেছে কিন্তু রূপ পাল্টায়নি। সংকট থেকে বেরিয়ে আসার আশা আপাতত তিরোহিত মনে হচ্ছে কিন্তু প্রগতিশীলরা এত সহজে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে রাজি নয়। সমাজের অনিবার্য দ্বান্দ্বিক পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক বীক্ষাই আমাদের ভরসা। বারান্তরে এই নিয়ে আলোচনা হবে।
লেখক : প্রবন্ধিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ