প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে জনপ্রতিনিধিসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার (২৭ মে) দলটির সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আবহাওয়া ভালো হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে যাবে। দলীয় সভাপতির পক্ষ থেকে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে সোমবার সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে উপকূলজুড়ে দেড় লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ঘূর্ণিঝড় রেমালে মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানান, এই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, আর আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। সর্বমোট দেড় লাখের বেশি ঘরবাড়ি আংশিক অথবা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে। যার প্রভাব দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় আজও অব্যাহত রয়েছে। রেমালের কারণে উপকূলীয় এলাকায় পানি ঢুকে মানুষের স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত করেছে। বেশ কিছু এলাকায় ঘর–বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশব্যাপী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সরকারের সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দুর্যোগপূর্ব কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এখন দুর্যোগ–পরবর্তী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে সরকারের পক্ষ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ঘূর্ণিদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের অনেকের অবস্থা হল ‘দৈনিক উপার্জনের মধ্য দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়’। এখনই খাবার পানি, শুকনা খাবার, বস্ত্র, চিকিৎসা, নগদ টাকা, ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। উৎপাদিত ফসল ও গবাদি পশুর ক্ষতি পোষাতে না পারলে দীর্ঘদিন দুরবস্থায় পড়বে এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। তাই পরিকল্পিত ভাবে এসব মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়তা দিতে স্বচ্ছতার সাথে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে।
নেতৃবৃন্দ সরকারি সহায়তা ছাড়াও যাদের পক্ষে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা সম্ভব তাদেরকে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। একইসঙ্গে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যবৃন্দসহ যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় এলাকায় মানুষকে সচেতন ও আশ্রয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তারা।
আসলে মানুষ যখন বিপদাপন্ন, তখন সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই দরকার। নানা ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী মানুষ যখন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়, তখন অন্য মানুষকে বিপদ–আপদ থেকে মুক্তির জন্য পাশে দাঁড়াতে হয়। অসহায় মানুষের দুর্দিনে তাদের সর্বপ্রকার আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, চিকিৎসাসেবা ও শুশ্রূষায় এগিয়ে আসার নাম মানবতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হওয়ার একটি বড় কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। পাহাড়ের বরফ গলে সমুদ্রে মিশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। লোনা পানি আমাদের নদ–নদীগুলোতে মিশে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে বিস্তৃত অঞ্চলে মাটির নিচে লবণাক্ত পানি ঢুকে যেতে শুরু করেছে। এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার পরিসর সীমিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তো একা একটি দেশের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে এর পেছনে দায়ী। এক্ষেত্রে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতি বছরই ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোধ করার কোনো উপায় নেই এটা যেমন ঠিক, তেমনি প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব– যা আমলে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রাখতে হবে।