মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক মহাসড়কের স্পিড লিমিটকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ এর সাথে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাস্তা ভালো এবং ওয়ানওয়ে হওয়ার কারণে অধিকাংশ সড়কে গাড়ির স্পিড লিমিট লংঘিত হয়। আর ঘাটে ঘাটে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। পুলিশ মামলা না দিয়ে ‘ক্যাশ’ আদায় করায় স্পিড লিমিটের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধ করতে সরকার বিভিন্ন রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের গতিতে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা দিয়ে স্পিড লিমিট করে দিয়েছে। এর বেশি স্পিডে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। কোন সড়কে কোন ধরনের যানবাহন কত স্পিডে চলবে তা ঠিক করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ থেকে ‘মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। উক্ত নির্দেশিকা অনুসরণ করে দেশের রাস্তাগুলোতে যানবাহন চলার কথা। ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে গতি সংক্রান্ত এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
নির্দেশনা অনুযায়ী, এঙপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার, ট্রাক ৫০ কিলোমিটার এবং মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে। অন্য গাড়িগুলো চলতে পারবে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার বেগে।
সড়কগুলোকে পৃথক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি এ) প্রাইভেটকার, এসইউভি, মাইক্রোবাস, বাস, মিনিবাসসহ হালকা যানবাহনগুলো সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। ট্রাক, বাইক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
জাতীয় সড়কে (ক্যাটাগরি বি) প্রাইভেটকার, এসইউভি, মাইক্রোবাস, বাস ও মিনিবাসের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার, বাইকের জন্য ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য ৪৫ কিলোমিটার। জেলা সড়কে বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, বাইক ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার গতি নির্ধারিত রয়েছে।
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা শহরের ভেতরের রাস্তায় প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন হালকা যানবাহন, বাস ও মিনিবাস সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার এবং ট্রাক, মোটরসাইকেল ও আর্টিকুলেটেড লরি ৩০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারবে। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার ও আবাসিক এলাকার কাছাকাছিতে জাতীয় সড়কে ৪০ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটারের বেশি বেগে কোনো গাড়ি চালানো যাবে না।
এই নির্দেশনা অমান্য করে কেউ বাড়তি গতিতে গাড়ি চালালে সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ অনুযায়ী তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্সকে এই নির্দেশনার বাইরে রাখা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই স্পিড লিমিট দেশের কোনো সড়ক–মহাসড়কে অনুসরণ করা হয় না। বিশেষ করে সড়কগুলোর অবস্থা ভালো হওয়ার পাশাপাশি দেশে নতুন গাড়ির সংখ্যা বাড়ায় সড়ক–মহাসড়কে হালকা যানবাহন কিংবা বাসগুলো ৮০ কিলোমিটার স্পিডে চলে না। এসব রাস্তায় প্রাইভেট গাড়িগুলো ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি বা বেশি বেগে চলাচল করে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সড়ক–মহাসড়কের ঘাটে ঘাটে পুলিশ চাঁদাবাজি করছে। সড়ক–মহাসড়কের জন্য সরকার হাইওয়ে পুলিশ গঠন করলেও এর সাথে থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিট বেশি গতির যানবাহন আটকে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করছে।
স্পিড লিমিট লংঘন করলে চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করার নিয়ম। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করে গাড়ির মালিক কিংবা চালক কাগজপত্র ফেরত নেবেন। কিন্তু পুলিশ বেশি গতির গাড়িগুলোকে মামলা না দিয়ে ক্যাশ নেওয়ায় সরকারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে নানা সূত্র ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এটা দুঃখজনক। ঘাটে ঘাটে গাড়ির মালিক এবং চালকদের হয়রানি করা হচ্ছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের একাধিক পয়েন্ট, মীরসরাইয়ের একাধিক পয়েন্ট, কুমিল্লা অঞ্চলের একাধিক পয়েন্টের পাশাপাশি চট্টগ্রাম–ফটিকছড়ি রোড, হাটহাজারী–রাউজান রোড, চট্টগ্রাম–কাপ্তাই রোড, চট্টগ্রাম–কঙবাজার রোডে স্পিড লিমিট নিয়ে নিয়মিত পুলিশের ‘ক্যাশ কারবার’ চলছে। বিভিন্ন বাস কোম্পানির সাথে মাসিক ব্যবস্থা থাকায় বেপরোয়া চলাচলকারী বাসগুলোকে আটক করা না হলেও প্রাইভেটকার ও জিপসহ হালকা গাড়িগুলো নিয়ে তৎপরতা চালায় পুলিশ।
ডা. ফয়সল আহমেদ নামে একজন চিকিৎসক গত রোববার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, হাটহাজারী–ফটিকছড়ি রাস্তাটা অনেক প্রশস্ত। যাচ্ছিলাম মানিকছড়ি। উদ্দেশ্য কোরবানির গরু দেখা। সাথে ছিলেন আমার এক বন্ধু পরিবার। গল্প করে নিজেই ড্রাইভ করছিলাম। হঠাৎ পুলিশের ইশারায় গাড়ি সাইড করলাম। পুলিশ জিজ্ঞেস করল, স্যার কত স্পিডে চালাচ্ছিলেন? আমি খেয়াল করিনি। উত্তরে বলল, এটা আন্তঃউপজেলা রাস্তা। সর্বোচ্চ স্পিড ৪০ কিমি। আপনি আরো জোরে যাচ্ছিলেন। আমি অবাক, এত সুন্দর রাস্তায় কিভাবে ৪০ কিমি গতিতে গাড়ি চলবে! আমাকে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলতে বলল। ওসি আনিস সাহেব অসম্ভব ভদ্র একজন মানুষ। একটা পুলিশ ভ্যানে খুব আলিশান কায়দায় বসেছিলেন। আমার পরিচয় জানতে চাইলে পরিচয় দিলাম। ওসি সাহেব অত্যন্ত ভদ্রলোক এবং বিনয়ী। বললেন, স্যার আপনি সম্মানিত মানুষ, আপনার নামে কেস দিলে আমার ভালো লাগবে না। তারপর আবার আপনাকে ১৫ দিনের মধ্যে হাটহাজারী থানায় এসে টাকা জমা দিতে হবে। এত ঝামেলা স্যার আপনাকে দিতে পারব না। আবার স্পিড গানে আপনার গাড়ি রেকর্ড হয়ে গেছে। এইটা ডিলিট করলে আবার বড় স্যারদের কৈফিয়ত দিতে হয়। ছোট চাকরি করি, অনেক ঝামেলা স্যার। আপনারা সম্মানী লোক, এইগুলা বুঝবেন না।
ডা. ফয়সল লিখেছেন, তারপর আরেকজন পুলিশকে ডাক দিয়ে বলল, স্যারের কাছ থেকে স্পট ফাইন নিয়া ছেড়ে দাও। ২৫০০ টাকার বদলে ১৫০০ টাকা নাও। আমি অপেক্ষা করছি রিসিট পাওয়ার জন্য। বলল, স্যার, আপনি চলে যান, সাবধানে গাড়ি চালাইয়েন। আমি সব বুঝেও চলে গেলাম। কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রশস্ত রাস্তায় স্পিড ৪০ কিমি, এটা ঠিক কিনা? স্পট ফাইন বলতে কিছু আছে কিনা? আনিস সাহেবদের প্রতিদিনের আয় কত?
শুধু ডা. ফয়সল আহমেদ নন, প্রতিদিন এভাবে শত শত মানুষকে পুলিশের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে পার পেতে হচ্ছে। রাস্তায় স্পিড লিমিটের তোয়াক্কা না করে বহাল তবিয়তে চালানো হচ্ছে গাড়ি।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্পিড লিমিট মানুষের স্বার্থেই দেওয়া হয়েছে। মানুষ না মানলে তাদেরই ক্ষতি। একটি গাড়ি অ্যাঙিডেন্ট করলে কী ভয়াবহ অবস্থা হয় দেখেন না?
তিনি বলেন, স্পট ফাইন বলে কিছু নেই। যেকোনো অপরাধে প্রথমে কেস স্লিপ দিতে হবে। কেস স্লিপের বিপরীতে অনলাইনে তাৎক্ষণিকভাবেও পেমেন্ট করার সুযোগ আছে। সেটার আবার মানি রিসিট রয়েছে। কেস স্লিপ ছাড়া কোনো ধরনের ফাইন বা অর্থ নেওয়ার সুযোগ পুলিশের নেই। তিনি বলেন, স্পট ফাইনের নামে যা নেওয়া হয় তা ওই কর্মকর্তার পকেটেই ঢোকে। মানুষ বেকায়দায় পড়ে এটা দিতে বাধ্য হয়।