তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ধারণ করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, লোকজীবন–সবকিছুতে ড. আনিসুজ্জামান গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
আমাদের সাংস্কৃতিক নভোদেশে ড. আনিসুজ্জামান ধ্রুবতারা। তাঁর আলোয় আমরা পথ চিনেছি, পথে চলেছি। ১৯৫২ থেকে ২০২০ প্রায় ৭০ বছর ধরে তার এই সংযুক্তি; ভাষা–আন্দোলন থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন, বাঙালি চেতনার উন্মেষ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্র জোয়ার, সেই সাথে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম–সবকিছুতেই ড. আনিসুজ্জামান সক্রিয়, সরব, প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৫২ সনে তিনি ঢাকায় বামপন্থি প্রভাবান্বিত যুব সংগঠন যুবলীগের দফতর সম্পাদক, মাত্র ষোলো বছর বয়সে–এই সংগঠনটি ভাষা আন্দোলনে নতুন গতিপথ নির্ধারণ করেছিলো ‘তমদ্দুন মজলিশ‘ এর প্রভাব বলয় অতিক্রম করে, সমগ্র পূর্ববাংলার জেলা–মহকুমা থানায় যুবলীগ এবং জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি গণসংগঠনসমূহের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ এর পরেও সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছিল এবং ক্রমে তা পূর্ব বাংলায় গণঐক্যের সৃষ্টি করে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয় পর্যন্ত নিয়ে যায়।
পূর্ববাংলায় জাগৃতির কালটিও এ সময় শুরু হয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পাকিস্তানি তমদ্দুন বিদায় নিলো, পরিবর্তে বাঙালির স্বকীয় সত্তার উন্মেষ ঘটলো। ড. আনিসুজ্জামানের সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বরূপ অন্বেষণে এই পর্বটির উন্মোচন তাই জরুরি। অবশ্য এটিও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিগত শতকের বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বঙ্গীয় মুসলিম লেখক–সাহিত্যিক–সংস্কৃতিকর্মীরা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি চেতনায় উদার মানবিক এবং জনগণের কল্যাণব্রতে সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের আকাঙ্ক্ষায় ব্রতী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, এস ওয়াজেদ আলী, ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও ‘শিখাগোষ্ঠীর’ সদস্য লেখকবৃন্দ, কবি জসীম উদ্দিন, সঙ্গীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন, নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এছাড়া ত্রিশ দশকের শেষে ও চল্লিশের দশকে মার্কসবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ লেখক, সংস্কৃতিকর্মী এবং তরুণ–রাজনৈতিক কর্মীরা পূর্ববাংলার তরুণদের বিশেষত মুসলিম তরুণদের মানসে যে আলোড়ন তুলেছিলেন, সে সবই পূর্ববাংলায় প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা উজ্জীবিত করতে শুরু করেছিলো গোটা পঞ্চাশ–ষাট দশকজুড়ে।
ড. আনিসুজ্জামান এই ধারাটিকে শক্তিশালী করে তোলেন। এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও পেশাজীবীদের কথা উল্লেখ করা যায় যাঁরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ–এই মনস্তাত্ত্বিক ধারণা বাঙালি ছাত্র–তরুণ, সংস্কৃতিকর্মী ও পেশাজীবীদের মানসভূমে বীজতলা হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। আনিসুজ্জামান স্বাধীনতার পূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী দশকের পর দশকজুড়ে সংবিধানের এই মৌলিক তত্ত্বীয় ধারণাগুলি বাস্তবে রূপ দিতে নয় কেবল, এসবে অর্জনে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন।
১৯৬৭–৬৮সালে যখন রবীন্দ্র বর্জনের ধুয়া তোলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও কিছু রবীন্দ্র বিরোধী লেখক, সেই সময় ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটি। এটি রবীন্দ্রচর্চার এক অসাধারণ গ্রন্থ। সেই প্রতিকূল সময়ে রবীন্দ্রনাথ আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও গণআন্দোলনে একাত্ম হয়ে গেলেন। ৬৮–৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের প্রতিনিয়ত সঙ্গী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাকলগ্নে চট্টগ্রামে লেখক–শিল্পীদের আন্দোলন–সংগ্রামে ড. আনিসুজ্জামান সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ছিলেন। সেই সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন। ‘আমার একাত্তর’ বইটি সেই সময়ের অসামান্য দলিল। স্বাধীনতার পর সংবিধান বাংলায় তরজমা করার দুরূহ ও শ্রমসাধ্য কাজে নিজেকে তিনি সঁপে দিয়েছেন।
১৯৭৫ এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সামপ্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সামরিক–স্বৈরাচারের যোগসাজশে দেশে ঘোর সামপ্রদায়িক, ধর্মান্ধ রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা করে। বছরের পর বছর এই অমানিশার কাল চেপে বসে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসামপ্রদায়িক জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে মুক্তিযোদ্ধা ও তারুণ্যশক্তির সচেতন আন্দোলন প্রয়াস ও জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে ড. আনিসুজ্জামান সারথির ভূমিকা গ্রহণ করেন। লেখা, আলোচনা, নানাবিধ সংগঠনে তিনি সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকা রাখেন। এই সময়টিতে তিনি সকল নাগরিক ও সামাজিক উদ্যোগে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নেন। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতির ভরসার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন। এই সময় শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূলনীতি রক্ষায় যে অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে, সেই বিপুল কর্মযজ্ঞে আনিস স্যারের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে।
বামপন্থি আন্দোলনের সাথে তাঁর নৈকট্য ছিলো। মার্কসবাদী বিশ্লেষণী ধারায় তাঁর সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গবেষণা পুষ্ট ছিলো। তাঁর লেখা ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা দেশের বামপন্থি ধারা ও ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় যুক্তি এবং সমসাময়িক ঘটনার নির্যাস তিনি তুলে ধরতেন যাতে শ্রোতা–দর্শকরা সহজে সমকালের স্বরূপটি চিনে নিতে পারে। তিনি কখনো তথ্যবিকৃতি বা একপেশে মন্তব্য করেননি কোনো আলোচনা বা লেখায়। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের রুচি, শিক্ষা, সংস্কৃতি চেতনা তথা এই সমাজের মানসজগত গঠনে তিনি অনেকটা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সৌজন্য, প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য, কর্মকুশলতায় মুগ্ধ হয়েছেন তাঁর সহকর্মী, শিক্ষার্থী, পাঠক, পেশাজীবী, তরুণ সাহিত্য–সংস্কৃতিকর্মী। এভাবে দশকের পর দশক দুই তিনটি প্রজন্মকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, অসামপ্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
উপমহাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি চিন্তায় তাঁর যে স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি, উভয় বাংলার সারস্বত সমাজে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সৃষ্টিকর্মে তিনি তাঁর স্বতন্ত্র অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা তাঁর নিরলস সাহিত্য সাধনা এবং উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির প্রতি মৌলিক চিন্তা ও রবীন্দ্র সাধনার স্বীকৃতি বহন করে।
ড. আনিসুজ্জামান বিশ্ব বাঙালি সত্তার উত্তরাধিকার নিজের জীবনে গ্রহণই করেননি কেবল, তাতে পুষ্টি দিয়েছেন। ক্রমেই তিনি আন্তর্জাতিক বাঙালি মানসের সার্থক প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। তিনি বিশ্ব বাঙালির চেতনার বাতিঘর, তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী