কুরআন ও হাদীসের আলোকে মদীনা মুনাওয়ারায় রওজা শরীফ যিয়ারতের ফযীলত
আল কুরআন’র আলোকে রাসূলুল্লাহর রওজা শরীফ যিয়ারত:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মুবারক যিয়ারত করা ও সেই মহান দরবারে রিছালতে হাজিরা দেয়া কুরআনুল করীমের আয়াত ও অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনুল করীমে এরশাদ হয়েছে, “যখন তারা নিজেদের আত্মার উপর অত্যাচার করে তখন হে মাহবুব! তারা আপনার নিকট আসলে এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করলে আর রাসুলও তাদের জন্য শাফায়াত করলে অবশ্য তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী এবং দয়াবান পাবেন।”(আল কুরআন, সূরা: নিসা, আয়াত: ৬৪)। আয়াতে বর্ণিত “ইয” অব্যয়টি ‘যখনই’ শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত, এ নির্দেশ শুধু প্রিয়নবীর তেষট্টি বৎসর জীবনের সাথে বা নবুয়তের পরবর্তী সময়ের জন্য নয় বরঞ্চ কিয়ামত অবধি সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। (তারিখে নজদে হিজাজ, পৃ: ১০৪)। সর্বাবস্থায় এ বিধান প্রযোজ্য।
একথা হাদীস বিশারদ ও মুজতাহিদ ইমামগনের নির্ভরযোগ্য দলীল প্রমাণের আলোকে স্বীকার্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে কোন তারতম্য নেই, খোদা প্রদত্ত তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যকারিতায় সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।
শরহে মাসালিক কৃত ইমাম ইবনে হুম্মাম বলেন, নিশ্চয়ই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার উপস্থিতি তোমার কিয়াম। তোমার সালাম অর্থাৎ তোমার সার্বিক অবস্থা তোমার সমুদয় কার্যক্রম তোমার গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন। ঈমানদার মুসলমানদের কাছে রওজা মোবারকের গুরুত্ব ও মর্যাদা অতুলনীয়। রওজা শরীফের যিয়ারত ও যিয়ারত উপলক্ষে সফর করাও এক বরকতময় উত্তম আমল হিসেবে বিবেচিত। ইমাম ইবনুল হুম্মাম এর মতে অন্য কোনো উদ্দ্যেশে নয় শুধু যিয়ারতে আকদাসের নিয়তে সফর করা এক উত্তম আমল। (আনোয়ারুল বিশারাহ কৃত ইমাম আহমদ রেযা)
তিনি রওজা শরীফ যিয়ারত প্রসঙ্গে আরো বলেন, রওজা শরীফে গমনকালে দরুদ শরীফ পাঠে নিজকে নিয়োজিত রাখুন। হেরমে মদীনা দেখা মাত্রই নগ্নপায়ে সামনে চলুন। ক্রন্দনরত মস্তক অবনত দৃষ্টিতে নিম্নগামী করুন, নুরানী সোনালী গম্বুজ দেখা মাত্রই অধিকহারে দরুদ সালাম নিবেদন করুন। এ নূরানী শহরে পৌছা মাত্রই অন্তরাত্মা সোপর্দ করুন। সর্ব প্রকার অনর্থক কথন ও কর্ম থেকে নিজকে মুক্ত রাখুন। সদা সর্বদা অজু গোসল সহকারে উত্তম ও পবিত্র কাপড় পরিধানে রাখুন। আতর গোলাফ ও সুগন্ধি ব্যবহার করুন, দরবারে রওজায়ে আকদাসে বিনম্রচিত্তে মনোনিবেশ করুন, রওজা শরীফে উপস্থিতির শুভ মূহুর্তে সালাত সালাম আরজ পূর্বক ধীর গতিতে সরকারে দোআলমের নুরানী দরবারে নিজকে সমর্পন করুন। এ অবস্থায় যেরূপ আদব ও তাজিম প্রদর্শন ফরজ প্রত্যক মুসলমান তা– অবগত। চোখ, কান, মুখ, হাত, পা, অন্তর আপাদ মস্তক নিজ সত্ত্বাকে সর্বপ্রকার ধ্যান ধারণা ও চিন্তা ভাবনা থেকে নিজকে পবিত্র রাখুন। এমনকি মসজিদের শোভাবর্ধন ও সৌন্দর্যের আকর্ষণ থেকে দৃষ্টিকে অবনত করুন। সাবধান কোনভাবেই যেন উচ্চকণ্ঠে বড় আওয়াজে তাজিমের পরিপন্থি বিন্দুমাত্র ব্যবহার প্রকাশ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন, যে মহান দরবারে ক্ষুদ্রতম অসম্মান জীবনের সকল পুণ্যময় আমল নিমিষেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। (প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৭১,৩৭২)
হাদীসে নববীর আলোকে রওজা শরীফ যিয়ারত:
রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারতে শাফায়াতের স্বীকৃতি রয়েছে এরশাদ হয়েছে, “হযরত নাফে (রা.) হযরত ইবনে ওমর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন যে, আমার রওজা যিয়ারত করেছে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়। (দারে কুতনী, বায়হাকী, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ৫৯, রাহাতুল কুলুব, পৃ: ২০৪)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জীবদ্দশায় সাক্ষাৎ করা ও তিরোধানের পর যিয়ারত করার ক্ষেত্রে কোন তারতম্য নেই, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার জীবন তোমাদের জন্য উত্তম আমার ওফাতও তোমাদের জন্য উত্তম। (বাযযার, (আল মুসনাদ ১ম খন্ড, হাদীস নং: ১৯২৫)
রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ্ব করল অত:পর আমার ওফাতের পর আমার রওজার যিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করলো। (হাফিজ আবু বকর আহমদ বিন হোসাইন বায়হাকী, ওফাত ৪৫৮ হি. সুনানে কুবরা, ৫ম খন্ড, পৃ: ২৪৬, তারিখে নজদে হেজাজ, পৃ: ১০৩)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কেবল আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার রওজা শরীফে আসবে কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে যাবে। (তাবরানী, দারেকুতনী, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ৬০, রাহাতুল কুলুব, পৃ: ২০৫)
যে ব্যক্তি কেবল হজ্ব করল যিয়ারতে রসুলকে গুরুত্ব দিলনা তার জন্য ভয়াবহ পরিণতির দু:সংবাদ রয়েছে। রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ্বে বায়তুল্লাহ আদায় করল, আর আমার যিয়ারত করলনা, সে আমার উপর অবিচার করল। (শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, যযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব, পৃ: ২০৬)
রওজা শরীফে সত্তর হাজার ফেরেস্তাদের নিয়মিত উপস্থিতি:
দরুদ সালাম এমন এক বরকতময় আমল যা স্বয়ং আল্লাহর সুন্নাত। আল্লাহর অগনিত ফেরেস্তারা প্রতিনিয়ত প্রিয় রসুলের দরবারে দিবারাত্রি সকাল সন্ধ্যা, প্রতিটি মুহূর্তে নবীজির নুরানী দরবারে দরুদ সালামের হাদীয়া নজরানা পেশ করে যাচ্ছেন ইবনে নাজ্জার কাবে আখবার থেকে বর্ণনা করেন, প্রতিদিন ফজরের সময় সত্তর হাজার ফেরেস্তা অবতরণ করেন তারা রওজা শরীফ আবৃত করে রাখেন এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরুদ শরীফ পাঠ করতে থাকেন, সন্ধ্যাবেলা ফেরেস্তাদের ঐ দল চলে যায়, সকাল বেলা অনুরূপ আরেক দল ফেরেস্তার আগমন ঘটে। দৈনিক এক লক্ষ চল্লিশ হাজার ফেরেস্তা নবীজির দরবারে দরুদ সালামের নজরানা পেশ করে থাকেন। (খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ: ১২০৭, মদীনাতুর রসুল, পৃ: ১৪৬)
রওজা শরীফ:
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নুরানী স্থানে সমাধিস্থ হয়েছেন, বিশ্বের মুসলমানদের কাছে তা রওজা মোবারক বা রাওজা শরীফ হিসেবে পরিচিত। নবীদের ইন্তেকাল আর অন্যদের ইন্তেকাল এক নয়। ব্যতীক্রম নবীদের ক্ষেত্রে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করার পর তাঁর দাফন কোথায় করা হবে তা নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত প্রকাশ করলেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবী যেখানে ইন্তেকাল করেন, সেখানে তাঁকে দাফন করতে হয়। (মসনদে আহমদ, ১ম খন্ড, পৃ:৭)
এ সম্পর্কিত বায়হাকী শরীফে নিম্নরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, এ প্রসঙ্গে আমার সঠিক জানা আছে যে, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবীগণ যেখানে ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাঁদের দাফন করতে হয়। অত:পর হযরত আবু বকর নির্দেশ দিলেন, তোমার প্রিয় নবীর বিছানা মোবারক সরিয়ে নাও এবং সেখানেই কবর শরীফ খনন করো। (ইমাম আহমদ বায়হাক্কী)
এভাবে প্রিয় নবীর প্রিয় শহর মদীনার বুকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এর নুরানী ঘরে যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন, সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। পরবর্তীকালে মসজিদে নববী সম্পসারনের ফলে রওজা মোবারক মসজিদে নববীর ভিতরে পড়ে যায়। (ইবনে ইসহাক, সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃ: ৬৮৮)
রওজা শরীফের মাটি আরশের চেয়েও উত্তম:
রওজা শরীফের মাটির যে অংশটুকু নুরে মোজাসসম সৈয়্যদে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নুরানী দেহ মোবারকের সাথে স্পর্শ মন্ডিত তা আরশ কুরসি এমনকি আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরীফের চেয়েও উত্তম বলে অসংখ্য ইমামগণ মত প্রকাশ করেছেন। ওয়াফাউল ওয়াফা প্রণেতা আল্লামা নুরুদ্দীন সামহুদি বর্ণনা করেন, নিশ্চয় রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকের সাথে সংশ্লিষ্ট মাটি ও ধূলিকণার শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সকল ওলামাদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত এমনটি পবিত্র কাবা শরীফের চেয়েও। হানফী মাযহাবের বিখ্যাত ফিকাহ গ্রন্থ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী প্রণীত ফতওয়া–এ শামী যিয়ারত অধ্যায়ে রয়েছে, রওজা মোবারকের যে মাটি রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারকের সাথে স্পর্শ মন্ডিত আছে তা আসমান জমীন এমনকি আরশে আযীমের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (ফতওয়ায়ে শামী, ৩য় খন্ড, যিয়ারত অধ্যায়)। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রওজা মুবারক যিয়ারত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।