(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
জমকালো নাস্তা করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম। কিন্তু হংকংয়ের সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের যে বিস্ময় সেই ঘোর থেকে যেনো বের হতে পারছিলাম না। বহুদেশে বহু কিছু দেখার সুযোগ আমার নানাভাবে হয়ে গেছে। মেট্রো স্টেশন, রেলওয়ে স্টেশন কিংবা বাস স্টেশনও কম দেখিনি। মনে মনে হিসেব কষে দেখলাম যে একশ’র বেশি এয়ারপোর্ট দেখার ভাগ্যও আমার হয়েছে। কিন্তু একটি সাধারণ মেট্রো স্টেশনের এমন তাক লাগানো আয়োজন মন থেকে মুছতে পারছিলাম না। বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছিল। তবে অপরূপ এবং নান্দনিক সব আয়োজন আমার অন্তরের প্রায় পুরোটাই দখল করে রেখেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আমরা আলীশান এক ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। কাজ নেই তো খৈ ভাজ টাইপের হাঁটা। আমাদের পাশ দিয়ে বহু নারী পুরুষ ঝড়ের বেগে পার হয়ে যাচ্ছিল। আমরা ধীরলয়ে জামাই হাঁটা হাঁটছিলাম। রাস্তার দুপাশেই সব সুউচ্চ ভবন। অসংখ্য শোরুম, দোকানপাট। সবগুলোই উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ। থরে থরে সাজানো পণ্যের বাহারী আহ্বান। কিন্তু আমরা কোন দোকানে বা শোরুমে ঢুকলাম না, কেবলই হাঁটছিলাম।
আমার বন্ধু স্বপন বললো, চল, সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। কিছু যদি পছন্দ হয় কিনতে পারবি। তারপর গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যাবো।
স্বপনের কথায় সায় দিলাম আমি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বেশ জমকালো একটি স্ট্রিট মার্কেটে পৌঁছে গেলাম। প্রচুর লোকজন। প্রচুর মানে প্রচুর। এতো বেশি লোকজন কেনাকাটা করছে যে রাস্তার পুরোটাই বন্ধ হয়ে রয়েছে। স্বপন বললো, এগুলো দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসে, রাতে চলে যায়। অফিস টাইমে এরা থাকে না। রাস্তায় গাড়ি চলে।
চারদিকে পণ্যের পসরা, বিকিকিনির মহোৎসব। রাস্তার দুই ধারে দোকান, প্রচুর পণ্য। এতো দামি এবং প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, চোখ সরানো যাচ্ছিল না। বিভিন্ন ধরনের জামা কাপড়, থ্রি পিস, ব্লেজার, ওভারকোটসহ হরেক রকমের কাপড়ছোপড়। সূচ থেকে রান্না ঘরের গ্যাসলাইটার পর্যন্ত যেনো রয়েছে। থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল, ছুরি কাচি এবং চামচের বাহার নজর কাড়ছে। কাপ এবং মগের যে সম্ভার সবগুলো কিনে নিতে ইচ্ছে করছে। আহারে, দুইটি কফি মগ নিলে দারুণ হতো। পাশাপাশি বসে কফিতে চুমুক দেয়ার তৃপ্তিটা মোহনীয় হয়ে উঠতো। কিন্তু এতদূর থেকে কাচের এসব জিনিস বহন করে নিয়ে যাওয়ার যে ঝক্কি তা আমাকে দমিয়ে দিল। আরে বাবা, এতো দেখি এলাহী কারবার! ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের পসরা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। মোবাইল সেট থেকে নানা এক্সেসরিজ ডালা সাজিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের ফুলগুলো মনে হচ্ছিল এই মাত্র বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে। রাস্তার দোকানে নতুন বউয়ের মতো সাজিয়ে রাখা এসব পণ্যের মান কেমন জিজ্ঞেস করলে স্বপন জানালো যে, হংকংয়ের কোথাও বাজে মানের পণ্য বিক্রি হয়না। সুপারমল থেকে ফুটপাত সর্বত্রই পণ্যের মান যথাসম্ভব অটুট থাকে। দরের পার্থক্যের জন্য কিছুটা হেরফের হলেও কোন পণ্যই একেবারে যাচ্ছেতাই মানের নয়। তুই চোখ বন্ধ করে কিনতে পারিস। আমি কোন কিছু নেবো কিনা জানতে চাইলো স্বপন। আমি মাথা নেড়ে নানা পণ্য দেখতে দেখতে হেলে দুলে সামনে এগুতে থাকলাম।
শত শত মানুষ, নারী পুরুষ। শিশু কিশোরও এসেছে পিতা মাতার সাথে। আমাদের মতো শুধু ঘুরতে থাকা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। অধিকাংশ মানুষের হাতে জিনিসপত্রের ব্যাগ রয়েছে। আমাদের মতো খালি হাতেও ঘুরছেন কেউ কেউ। হংকং আসলে পর্যটক বান্ধব এক নগরী। তাবত দুনিয়ার হাজারো মানুষ প্রতিদিন হংকং বেড়াতে আসে, ব্যবসা করতে আসে। নানা কাজে হংকং আসা লোকজন স্ট্রিট মার্কেট থেকে কেনাকাটা করে দেশে নিয়ে যায় বলেও স্বপন জানিয়ে স্বপন একটু হাসলো। বললো, সুপারমলের তুলনায় এখানে দাম সস্তা থাকার কারণে গিফট আইটেমগুলো মানুষ এখান থেকেই কিনে নিয়ে আত্মীয় স্বজনকে বুঝ দেয়। আমি কিনবো নাকি কিছু বলে স্বপন বেশ রহস্যজনকভাবে তাকালো আমার দিকে। বললাম, নারে ভাই। আমি বিদেশ থেকে গেলে কেউ কোন কিছু আশা করে না। না পরিবার পরিজন, না কোন স্বজন। সুতরাং আমাকে কোন ঝামেলা ফেলানোর ধান্দা করিস না। আর কি কি দেখার আছে সেখানে নিয়ে চল।
পায়ের তলায় ব্যথা করছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সেটি স্বপনকে বলতে পারছিলাম না। এখানে মানুষ এতো কেমন করে হাঁটে কে জানে! সারাদিনই হাঁটার উপর থাকে। এজন্যই মনে হয় এরা এতো স্লিম, কী দুর্দান্ত এক একটি ফিগার। হোক সেটি পুরুষের, কিংবা নারীর।
আরো বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা একটি পার্কে এসে পৌঁছালাম। গাছগাছালীতে ভরা, গাছের ছায়ায় বসার দারুণ বেঞ্চ। হেলান দেয়ার স্টাইলই যেনো আলাদা। স্বপন আমাকে নিয়ে পার্কের ভিতরে হাঁটার চেষ্টা করলো। আমি বললাম, চল, কিছুক্ষণ বসি। মানুষ দেখি। তারপর না হয় হেঁটে পার্ক দেখবো। অনেকেই আছেন পার্কের ভিতরে। উন্মুক্ত পার্ক। কোন টিকেট লাগেনি। মানুষ ঢুকছে, বের হচ্ছে। শরীর চর্চার জন্য হাঁটছে কিছু মানুষ। ওয়াকওয়েটিও বেশ নান্দনিক। গাছ গাছালীর ভিতর দিয়ে হাঁটার আমেজই অন্যরকম। শরীর চর্চাকারী নারী পুরুষের পোশাকের অবস্থা খুবই চোখে লাগছিল। অবশ্য, হংকংয়ের রাস্তাঘাটেও নারীদের পোশাকের তেমন একটি বাহুল্য নেই। যা হয় একটা কিছু গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে পড়ার মতো। অধিকাংশর পরনেই শর্টস এবং টপ। এসব দিকে তাদের যেমন খেয়াল নেই, খেয়াল নেই অন্য কারোও। তারা অভ্যস্ত। শুধু হঠাৎ দেখলে একটু চোখে লাগে এই আর কি!
আমরা বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তবে এখানে বাদাম চানাচুর খাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে কেউ কেউ চিপস খাচ্ছিলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে এমন একটি পার্কের কোথাও কোন ময়লার স্তুপ নেই, চিপস কিংবা সিগারেটের প্যাকেট নেই। খালি বোতল বা ক্যানের ছড়াছড়ি নেই। চারদিক একেবারে ঝকঝকে। গাছগাছালী পুরো পার্কটিকে ছায়া দিয়ে রাখলেও কোথাও একটি গাছের পাতাও পড়ে নেই, নেই একটি ভাঙ্গা ডালও। বেঞ্চগুলোতেও নেই ধুলোবালির আস্তর। কী যে স্নিগ্ধতা চারদিকে। গাছে গাছে প্রচুর পাখির উড়াউড়ি, কিন্তু কোথাও পাখির ময়লাও দেখা গেলো না। হংকংয়ের পাখিরাও বুঝি সভ্য হয়ে গেছে!
স্বপন বললো, চল, কিছুক্ষণ ঘুরে টুরে দেখি। আমিও দাঁড়ালাম। ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। পায়ের চিনচিন ব্যথা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ায় উবে গেছে। এমন মনোরম একটি পরিবেশে মানুষ দেখে দেখে হাঁটতে আর খারাপ লাগছিল না। পার্কের একপাশে ওয়াশরুম দেখা গেলো। যাবো কিনা জানতে চাইলো স্বপন। ফ্রি। কোন টাকা কড়ি দিতে হয় না। শুধু দেখার জন্য গেলাম। কী সুন্দর ওয়াশরুম। একেবারে পরিস্কার। বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের আনুষঙ্গিক সুবিধাগুলোও রয়েছে। ওয়াশরুমের বাইরেও কয়েকটি পানির কল দেয়া আছে। দুই তরুণীকে দেখলাম বেশ আয়েশীভাব নিয়ে হাত মুখ ধুচ্ছে। গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। হেঁটে কাহিল হয়ে উঠা ওই দুই তরুণী শরীরের উন্মুক্ত স্থানে পানির পরশ বুলিয়ে স্বস্তি নিচ্ছে। একজনকে দেখলাম বোতলে পানি ভরছে। স্বপন বললো, এগুলো ড্রিংকিং ওয়াটার। তুই চোখ বন্ধ করে খেতে পারিস। কোন অসুখ হবে না।
একেবারে স্বয়ংসম্পুন্ন একটি পার্ক। যেখানে যা দরকার তার সবই যেনো পার্কটিতে রয়েছে। নাগরিক সুবিধার জন্য এর থেকে বেশি কিছু দরকারই নেই একটি পার্কে। পার্কের ভিতরে কোনকিছুর বিকিকিনি না চললেও বাইরে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। রয়েছে খাবারের দোকানও। কেউ কেউ পার্কে বসে বার্গার স্যান্ডউইশ টাইপের খাবার খাচ্ছিলো। উচ্ছ্বিষ্ট নিয়ে ফেলা হচ্ছিল বিনে। পার্কের নানা কর্ণারে অনেকগুলো বিন দেখা গেলো। বিন উপচে কোন ময়লা নেই। বিনের পাশেও অনায়াসে বসে পড়ার মতো আবহ দেখে আমার কেমন জানি হিংসে হচ্ছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।