মাত্র ৬৬ বছরে জীবন প্রদীপ নিভে গেল পত্রলেখক এম.এ গফুরের। অন্তত চল্লিশ বছর ধরে দৈনিক আজাদীসহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় শত শত চিঠিপত্র লিখে তিনি অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৯৭–৯৮ সনে আমি তখন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঈশানে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। এম এ গফুর আজাদী ছাড়াও দৈনিক ঈশানেও নিয়মিত চিঠিপত্র কলামে লিখতেন। তখন থেকেই আমি তাঁকে চিনি ও জানি। দৈনিক ঈশানের স্টাফ রিপোর্টার শামসুল আলম টগর সম্ভবত ১৯৯৮ সনে পত্রলেখক এম এ গফুরকে নিয়ে বড় একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তখনই চট্টগ্রাম–ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি প্রায় পাঁচ হাজার চিঠি চিঠিপত্র কলামে লিখেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অনেক পত্রলেখক পরবর্তীতে পত্র পত্রিকায় নানা কলাম–লেখা শুরু করার কথা আমরা জানি। পত্রলেখক থেকে ফুল টাইম খ্যাতিমান লেখক হয়ে ওঠেন অনেকে। কিন্তু এম এ গফুর আজীবন পত্রলেখকই থেকে গেলেন। দেশ ও সমাজে বিরাজিত নানা সমস্যা, মানুষের অভাব অভিযোগ–চাওয়া পাওয়া এসবই ছিল এম এ গফুরের লেখালেখির বিষয় আশয়। মানুষের নানা সমস্যা–অভিযোগের কথা তাঁর লেখায় ওঠে আসতো। আবার কোনো ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের ভালো কাজের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ থাকতেন। তাঁর একাডেমিক পড়াশোনা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু প্রতিদিনই তিনি ঢাকা–চট্টগ্রামের পত্র পত্রিকাগুলো বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। তা বোঝা যেত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার ওপর তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে। তিনি বড় লেখক হতে চাননি। তাঁর লেখার পরিসর থাকতো কয়েক শ শব্দের মধ্যে সীমিত। বড় লেখা তিনি লিখতেন না। অথচ লেখার আকার আকৃতি বড় হলে তিনি আর্থিকভাবে ফায়দা পেতেন। অর্থাৎ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বড় লেখার জন্য কম–বেশি সম্মানী দেওয়া হয়। কিন্তু এম এ গফুর নিজেকে পত্রলেখক হিসেবেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। পত্রপত্রিকায় আজীবন শত শত চিঠিপত্র লিখেছেন নিজের গরজে। অথচ কখনো কোনো পত্রিকা থেকে একটাকা সম্মানীও পাননি। যেহেতু চিঠিপত্র লেখার জন্য কোনো পত্রিকায় সম্মানী দেওয়া হয় না। তবে জীবদ্দশায় তিনি কয়েক বছর আগে দৈনিক আজাদী থেকে সম্মাননা পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। এটাই হয়তো তাঁর সারা জীবনের বড় প্রাপ্তি। সর্বস্তরের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ, দেশপ্রেম ও সামাজিক কতোটা দায়বদ্ধতা এম এ গফুরের মাঝে ছিল তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তাঁর স্থায়ী নিবাস চট্টগ্রাম নগরের কোরবানিগঞ্জ এলাকায়। তিনি প্রতিদিনই চিঠি লিখতেন। আবার পায়ে হেঁটে এসে দৈনিক আজাদীতে চিঠিগুলো পৌঁছে দিতেন। মৃত্যুর তিন দিন আগেও চিঠি নিয়ে তিনি আজাদী ভবনে এসেছিলেন। তাঁর খুব বেশি আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। মোটামুটি সাধারণ মানের জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বড়। দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। দেশের দুরবস্থা, মানুষের নানা সমস্যা–অভিযোগ দেখে তিনি পীড়িত হতেন। ফলে পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখে স্বস্তি পেতেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল সুন্দর। চমৎকার লিখতেন। তাঁর লেখায় বানান–বাক্যে তেমন ভুল থাকতো না। তাঁর লেখা কাটাকাটি বা সম্পাদনার খুব একটা প্রয়োজন হতো না। তিনি যা ভেবেচিন্তে লিখতেন তাই প্রায় হুবহু পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তাঁর লেখার মধ্যে তথ্য–উপাত্ত থাকতো। তিনি যে বিষয়ে লিখতেন, সে বিষয়ে জোরালো তথ্য–যুক্তি তুলে ধরতেন। দিন–রাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত দুই–তিন ঘণ্টা যে তিনি লেখালেখি ও পত্র পত্রিকা পড়াশোনায় ব্যয় করতেন তা অনায়াসে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটা অলাভজনক কাজ। তাতে আর্থিক ফায়দা না থাকলেও মনের তাগিদে বিবেকের তাড়নায় তিনি অহর্নিশ লিখতেন। তাঁর হৃদয়ের প্রাচুর্য এবং জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এতে আমরা অনুধাবন করতে পারি। লেখালেখির মাধ্যমে ঘুণে ধরা সমাজ বদলে দেয়ার স্বপ্নই দেখতেন এম এ গফুর।
পত্রলেখক এম এ গফুর আজীবন এই কাজই করে গেছেন কোনোরূপ পার্থিব চাওয়া–পাওয়ার ঊর্ধ্বে ওঠে। এরকম নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী ও সমাজদরদী মানুষ আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না। পত্রপত্রিকা সংবাদপত্রে কোনো বিষয়ে লেখালেখি হলে বেশ প্রভাব পড়ে বলে আমরা জানি। সরকার বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণের বড় জায়গা হলো পত্রিকার চিঠিপত্র স্ত্বম্ভ। সম্পাদকীয় পাতার বড় আকর্ষণ হলো এই চিঠিপত্র বিভাগ। এতে নানাজনের নানা মত, বিচিত্র অভাব অভিযোগ ওঠে আসে। তাই পত্রিকার চিঠিপত্র কলামকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন পত্রলেখক এম এ গফুর। তিনি অবিরাম লিখে গেছেন। কিন্তু লেখার বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাননি কখনো। এটাই মূলত তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতো নিবিষ্ট পত্রলেখক শুধু চট্টগ্রাম নয় সারা দেশে আরেকজন খুঁজে পাওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতিবছর চট্টগ্রামের শিক্ষা, সাংবাদিকতা, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সম্মাননা ও পুরস্কৃত করে আসছে। আমরা আশাকরি চট্টগ্রামের একেবারে তৃণমূলের প্রচারবিমুখ লেখক এম এ গফুরকে লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে মরণোত্তর সম্মাননা ও পুরস্কৃত করবে চসিক। এম এ গফুর ৬৬ বছরের জীবনে পত্র–পত্রিকায় হাজার হাজার চিঠিপত্র লিখে আজীবন মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। এখন তাঁকে দেওয়ার পালা আমাদের। সম্মান ও স্বীকৃতির জন্য তিনি কোনো কাজ করেন নি। তবুও তাঁর কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন হলে দেশ ও সমাজে তাঁর মতো আরও বহু এম এ গফুর ওঠে আসবে সন্দেহ নেই।
সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লিখে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত লেখক হয়ে উঠেছেন এমন অনেকের কথা আমরা জানি। আমি নিজেও এক সময় পত্রপত্রিকায় প্রচুর চিঠিপত্র লিখেছি। এখনো লিখি। তবে এখন নিবন্ধই লিখি বেশি। ১৯৯৫ সনে পত্রলেখক–লেখিকা গোষ্ঠী ‘পলগ’ আয়োজিত চিঠিপত্র প্রতিযোগিতায় আমি ২য় স্থান অর্জন করেছিলাম। তখন আমাদের লেখক সংগঠন আদর্শ লিখক ফোরাম–আলিফ এবং পলগের সদস্যরা সমানতালে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছিল। তখন সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাও গতিশীল ছিল। আমাদের আলিফের সভাপতি ছিলেন শিক্ষাবিদ–ছড়াকার অধ্যাপক ড. নূ ক ম আকবর হোসেন। তিনি লেখালেখিতে আমাদের উৎসাহ জোগাতেন। আর পলগের নেতৃত্বে ছিলেন আনিসুল ইসলাম রিয়াদ, ফরিদা ফরহাদ ও মুহাম্মদ নুরুল আবসার। দৈনিক আজাদীর বর্তমান সহযোগী সম্পাদক কবি–ছড়াকার–সাংবাদিক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব রাশেদ রউফ অগ্রজ হিসেবে আমাদেরকে লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা দিতেন। তিনি এবং চট্টগ্রামের গুণী ব্যক্তিত্বরা পলগ ও আলিফের নানা অনুষ্ঠানে অতিথি ও আলোচক হিসেবে থাকতেন। কবি–সাংবাদিক রাশেদ রউফের পরিচালনায় চট্টগ্রামে প্রায় তিন দশক আগে গড়ে ওঠে সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির সুন্দর প্লাটফর্ম– ‘স্বকাল।’ সময়ে সময়ে ‘স্বকালের’ সাহিত্যাসরে তরুণ–প্রবীণ লেখকরা অংশ নিয়ে আসছেন। এখনো ‘স্বকাল’ লেখালেখি অঙ্গনে বড় ভূমিকা রাখছে এবং লেখক তৈরিতে অবদান রাখছে। অন্যদিকে ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ প্রায় আড়াই দশক ধরে চট্টগ্রামের সাহিত্য, কৃষ্টি সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে অসামান্য কাজের স্বাক্ষর রাখছে। ১৯৯৯ সনের ২৯ এপ্রিল নগরীর নূর আহমদ সড়কস্থ মেট্রোপোল চেম্বারে আলিফের উদ্যোগে লেখালেখি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. মহীবুল আজিজ, কবি রাশেদ রউফ ও কবি এজাজ ইউসুফী প্রশিক্ষক ছিলেন। এ ধরনের নানা উদ্যোগের ফলে ২৫–২৬ বছর আগে চট্টগ্রামে লেখালেখি অঙ্গনে একটা ‘স্রোত’ তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে তা অনেকটা ‘নিষ্প্রভ’ হয়ে ওঠা লেখকদের জন্য শুভবার্তা দেয় না। স্বকাল, পলগ ও আলিফের আরও বেশি সক্রিয়তায় চট্টগ্রামে আবারো নতুন লেখক তৈরির পথ উন্মুক্ত হবে এবং সাহিত্য–সংস্কৃতিচর্চা বেগবান হবে–এ আশা করা যায়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক