‘মা’ একটি অক্ষর, একটি শব্দ, কিন্তু ব্যাপকতা প্রচুর। এই শব্দটি সকলের সবচেয়ে পছন্দের শব্দ এবং এই শব্দ থেকেই সৃষ্টি একটি ব্যক্তিত্ব। এটা এমন একটা ব্যক্তিত্ব, যেটা সব পরিবেশে, সবসময় সবার কাছে সবচেয়ে আপন। এই আপন শব্দ মাকে নিয়ে উদযাপন করার জন্য আলাদা একটি দিন তা ভাবতেই খুব ভালো লাগে। অবশ্য মাতৃভক্তরা তো বলেই থাকে প্রতিদিনই তাদের কাছে মায়ের জন্য মা দিবস, সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু সবার মা যদি সবার কাছে প্রতিদিন মা দিবস নিয়ে মনের কৌটরে সত্যি সত্যি আসীন থাকতো, তবে এত বৃদ্ধাশ্রমে মাদের দেখা যেত না। সে যাই হোক, মাকে নিয়ে আলাদা একটি দিন, উদযাপনের দিন, ভালোলাগার দিন, মায়েদের পরিতৃপ্তির দিন।
সাধারণত মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে বিশ্ব মা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের পর শান্তির জন্য বছরের একটি দিন মা দিবস হিসাবে পালনের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেন নারী নেত্রী জুলিয়া এয়ার্ড। পরবর্তীতে এনা জারভিস নামে এক সমাজকর্মী দুস্থ মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে মাদার্স ওয়ার্ক ডে নামক একটি ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। ১৯০৫ সালের মে মাসে তিনি মারা যান। তার মেয়ে দ্বিতীয় এয়ানা মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস হিসাবে পালনের উদ্যোগ নেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মা দিবস পালিত হয়। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন অবশেষে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেন (সংকলিত)। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন এই মা দিবস নিয়ে নানা আয়োজনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং পারিবারিকভাবে পালন করা হচ্ছে।
বিশ্বের সব মায়েরা সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন থাকুক, এটাই প্রত্যাশা। সাধারণত এর ব্যত্যয় হয় তখনই যখন সন্তান ঠিকঠাক মানুষ হয়ে উঠে না, বা যে কোনো কারণে মানুষ হয় না। জ্ঞানীরা বলেন, ‘কুসন্তান অনেক হ , কিন্তু কুমাতা কদাচ নয়,’ এই লাইনটিতে মা শব্দের যথার্থ মর্মকথা নিহিত আছে। মা হতে হলে অনেক বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করতে হয়। মা দিবসকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে, মেয়েদেরকে মা হয়ে উঠার দিকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। মা হওয়া কি মুখের কথা! না, মা হওয়া সহজ ব্যাপার না। সন্তানের জন্ম দিলেই মা হওয়া হয় না।
‘মা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো যিনি মেপে দেন, কাকে মেপে দেন? এর উত্তরে হবে সন্তানকে, কী মেপে দেন? এর উত্তর হলো, সন্তানের জীবনধারা। যিনি সন্তানের জীবনধারাকে গুণগত ও পরিমানগত ভাবে মেপে দেন তিনিই মা। আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় সামাজিক রীতিনীতি মেনেই মা হতে হয়, এর অন্যথা হলেই মা তার পবিত্রতা হারায়, যথার্থতা হারায়। মা হওয়ার পূর্বশর্ত হলো বিবাহ নামক সংস্কারে আবদ্ধ হওয়া। ’বিয়ের মাধ্যমে নারী পুরুষ উভয়ে পরস্পরের ভার বহন করা, অর্থাৎ পরস্পরের দায়িত্ব গ্রহণ করার শর্ত নিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি সহ এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। বিবাহ আয়োজনের পূর্ণতার সাথে সাথে হয় সংস্কারের সৃষ্টি। সংস্কারে থাকে কিছু নীতি, কিছু আদর্শ, কিছু দায়িত্ব, কিছু ত্যাগ, কিছু সামাজিকতা, কিছু বোঝাপড়া এবং সর্বোপরি প্রজননের। মা তখনই সার্থক যখন এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে জন্ম নেওয়া সন্তান সঠিক নির্দেশনায় লালিত হবে।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র বিশ্ব মাদের কাছে ঋণী, কেননা মাদেরকে মা হয়ে উঠার জন্য বাবার বাড়ির আপন জনদের স্নেহ, মায়া মমতা শৈশব কৈশোর এসব ছেড়ে পরের বাড়িকে আপন করে নিয়ে বংশানুক্রমিতা রক্ষা করার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মা হয়, সন্তানকে আদরে, আহ্লাদে যত্নে এবং বহু ত্যাগ–তিতিক্ষার মাধ্যমে সন্তান লালন–পালন করে। মায়েরাই পারে সন্তানকে তিল তিল করে গড়তে, মায়েদের এই তিল তিল প্রচেষ্টায় একদিকে থাকে ত্যাগ, ধৈর্য্য, প্রজ্ঞা, মেধা, বুদ্ধি, বোধ, বিবেচনা, সংযম, পরিশ্রম অন্যদিকে গঠিত হয় সন্তানের জীবনধারার গতি, যেই মা যতবেশি সুচারুরূপে এই কাজগুলোর প্রতিফলন ঘটাতে পারে, তার সন্তান ততবেশি সফল, এবং সেই মা তত বেশি সার্থক। সার্থক মাদের অবদান এর ফলে গঠিত হয় সুন্দর সমাজ, সুতরাং মায়েদের ত্যাগ জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য।
মায়েদের সার্থকতার মূল সোপান হলো অর্জিত সঠিক নির্দেশনার সঠিক পন্থা অবলম্বনে সন্তান লালনের কৌশল। এই কৌশল আয়ত্ত করতে প্রয়োজন শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রায়োগিক শিক্ষারও প্রয়োজন। কারণ মা যে চিন্তা চেতনায় শিশুকে বড় করে তোলেন, সেই বোধ, স্বভাব চরিত্র, ধ্যান–ধারণা, কর্মপ্রেরণা, নিয়েই শিশু পরবর্তী কালে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠে। মা এর সঞ্জিবনী দুগ্ধধারার মাধ্যমে যেভাবে দৈহিক পুষ্টি সাধিত হয়, তেমনি মা এর আচার আচরণ, চিন্তা চেতনা, মনন, বোধ, ইত্যাদিও একটু একটু করে সন্তান আয়ত্ত করে নেয়। সুতরাং সন্তানের ভিতর এই বোধ সমূহ জাগানোর জন্য মায়েদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মায়েদের আরো বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের মা বাবারা আমাদেরকে যেভাবে বড় করেছেন, সেভাবে চলতে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। চারিদিকে অরাজকতা খুন খারাবী, আড্ডা, নেশাগ্রহণ, সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার, এত ব্যাপক যে সন্তানদেরকে নজরদারী তথা সতর্ক খেয়ালে না রাখলে চোখের পলকে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত উপস্থিত হতে পারে। বিশ্বায়নের এই ডিজিটাল যুগে সমাজ যেমন অনেক খানি এগিয়েছে, তেমনি আমাদের সন্তানদের বোধ বিবেচনা, ক্ষিপ্রতা, চাতুর্যতা, দুষ্টুমিও অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। সন্তানদের চাতুর্যপূর্ণ বুদ্ধি,-জ্ঞান সম্পন্ন আচার–আচরণগুলোকে খেয়াল রাখতে হবে অনুসন্ধিৎসু নিরীক্ষণের মাধ্যমে। সারাক্ষণ বন্ধুসুলভ ব্যবহার দিয়ে চাতুর্যপূর্ণ আচরণ গুলোকে মোকাবেলা করতে হবে। মায়েদের সামান্যতম অবহেলা সন্তানের জীবনের বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সব সন্তান অবশ্য সমান নয়, এ কথা যেমন ঠিক, আবার বেশির ভাগ সন্তান এখন মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্তানরা মা–বাবা, টিচারদেরকে ফাঁকি দেওয়া বা মিথ্যা বলাতে আনন্দ উপভোগ করে। এগুলোর দিকে মা–বাবাকে কৌশলী হয়ে সন্তানকে পরিচালিত করতে হবে, নয়তো, সন্তান ও মা–বাবা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর তথা সমাজের, সর্বোপরি রাষ্ট্রের। দীর্ঘ শিক্ষকজীবনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় নানা রকমের মিথ্যার সাথে পরিচিত হওয়ার দুর্ভাগ্য হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সামান্য সুবিধালাভের জন্য জীবন্ত দাদা–দাদীকে হর–হামেশা মেরে ফেলে, সবচেয়ে দুঃখ হয়, যখন একাডেমিক বিষয় বা আর্থিক বিষয়ের সুবিধা নেওয়ার জন্য নিজেদের জীবন্ত মা–বাবাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না। শিক্ষক এবং অভিভাবক উভয়ের সাথেই মিথ্যা দিয়ে লুকোচুরি খেলে। তাই মা–বাবা উভয়কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়, সন্তান লালন–পালনে। কেন না প্রতিটি মার নিকট তাঁর সন্তান এক অমূল্য সম্পদ।
প্রায়ই তো ক্ষতি হচ্ছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, বন্ধু খুন করছে বন্ধুকে, মা–বাবা হারাচ্ছে তাদের আদরের ধন। খুন কী জিনিস বোঝার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে কৈশোর প্রাণ। আবার সন্তানের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে মা আত্মহত্যা করতে দ্বিধা করছে না। তাই অনাগত ভাবী মাদের প্রতি কবিগুরুর লাইন এর মতো করে আচরণ করা প্রয়োজন। কোলে তুলে লও এরে/ এ যেন কেঁদে না ফেরে/হরষেতে না ঘটে বিষাদ/, বুকের মাঝারে নিয়ে/পরিপূর্ণ প্রাণ দিয়ে/ইহাদের করো আশীর্বাদ। কবিগুরুর আশীর্বাদ কবিতার মতো মায়েরা তাদের সন্তান লালনে সচেষ্ট হলে মা দিবস এর সার্থকতা বহুগুণে বেড়ে যাবে।
সার্থক মায়েরা, সার্থক সন্তানেরা জাতিকে গৌরবান্বিত করে। মা দিবস, বিশ্ব মা দিবসে সকল মায়েদেরকে জানাই পরম শ্রদ্ধা। সাধারণ মা যারা নিরন্তর চেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে সন্তান লালন–পালন করেছেন, সেসব নিঃস্বার্থ মায়েদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। পরম প্রতিকূলতায় যেসব নারী মাতৃত্বকে করেছেন সফল, সেইসব মাও নমস্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ–নূর ডিগ্রি কলেজ