পাইপসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নগরীতে গ্যাসের এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত মোটামুটি গতিতে চললেও সামনের দিনগুলোতে থমকে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশিন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ইতোপূর্বে স্থাপিত ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটারের সুফল পাওয়ার পর নগরীর হাজার হাজার গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। গ্রাহকদের প্রচন্ড আগ্রহ থাকলেও রাইজার থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আলাদা লাইন তৈরি করার খরচের বাধ্যবাধকতার জন্য অনেকেই পিছু হটছে। এদিকে শুধু শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলের গ্যাস লাইনও প্রিপেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, গ্যাস সেক্টরের আবাসিক খাতে গ্যাস চুরি, অবৈধ এবং চোরা সংযোগ বন্ধ এবং সর্বোপরি অপচয় ঠেকাতে সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামের গ্রাহকদের প্রি পেইড মিটারের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় বছর দশেক আগে। আমলতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে গ্যাস লাইনে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে। ২০১৮ সালে নগরীতে ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল। বছর দেড়েক সময়ের মধ্যে নগরীর জামালখান, হালিশহর, চান্দগাঁও, কোতোয়ালী, খুলশী, নাসিরাবাদ, লালখান বাজার, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, কাজীর দেউড়ি, পাঁচলাইশসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ৬০ হাজার আবাসিক গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হয়। জাপান সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় এসব মিটার স্থাপন করা হয়। কর্ণফুলী গ্যাসের প্রায় ৬ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মাঝে প্রথম দফায় ৬০ হাজার গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দেয়া হলে বেশ সাড়া পড়ে।
জাপান থেকে আনা উন্নতমানের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পর নগরীর আবাসিক খাতে গ্যাসের খরচ বহুলাংশে কমে যায়। কমে যায় গ্যাসের অপচয়। এক চুলা কিংবা দুই চুলা হিসেবে নির্দিষ্ট হারে যে বিল গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়, তার থেকে অনেক কমে পুরো মাসের রান্নার কাজ সেরে যাওয়ায় প্রিপেইড সিস্টেম জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এতে চট্টগ্রামে গ্যাসখাতে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, চুলা না জ্বালালে কোন বিল আসে না। আবার নিজেরাও ইচ্ছে করলে বিল সাশ্রয় করতে পারছে। পোস্টপেইড চুলা থেকে প্রিপেইড মিটারে খরচ প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকেরা এই সিস্টেমের আওতায় আসার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে।
গ্রাহকদের ব্যাপক আগ্রহের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে চট্টগ্রামে নতুন করে আরো ১ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের জন্য পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২৪১ কোটিরও বেশি টাকার একটি প্রকল্পটির নানা প্রক্রিয়া শেষ করে আজ থেকে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয় গত জানুয়ারি মাসে। জাপানের টয়োকিকি কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করবে। গ্রাহকদের বাসাবাড়ির লাইনগুলো প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উপযোগী হলেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাইজারের পাশেই প্রিপেইড মিটার স্থাপন করে দেয়া হবে। এজন্য কোন ফি বা টাকা নেয়া হবে না। তবে লাইন ঠিক না থাকলে প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে না। রাইজার থেকে রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত পাইপ লাইনে কোন লিক থাকলে কিংবা একই লাইনে একাধিক চুলা থাকলে সেখানে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের সুযোগ নেই। অনেক বাড়িতে রাইজার থেকে একটি লাইন নিয়ে তা থেকে পুরো বিল্ডিং এর সবগুলো চুলাতে সাব লাইন দেয়া হয়ে থাকে। প্রিপেইড মিটার স্থাপনের আগে এই ধরণের লাইনগুলো সিঙ্গেল লাইন অর্থাৎ রাইজার থেকে একটি চুলা পর্যন্ত লাইন টেনে নিতে হবে। রাইজার থেকে একাধিক চুলার জন্য একটি লাইন টানা থাকলে সেখানেও প্রিপেইড মিটার স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। রাইজার থেকে চুলা পর্যন্ত গ্রাহক নিজ খরচে লাইন ঠিকঠাক এবং আলাদা করে দেয়ার পরই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে এই লাইন আলাদা করার বাড়তি খরচের জন্যই অনেকেই প্রিপেইড মিটার স্থাপন থেকে পিছু হটছে।
পাইপসহ আনুষাঙ্গিক জিনিজপত্র এবং মিস্ত্রির মজুরি বৃদ্ধির কারণে বহু গ্রাহকই প্রিপেইড মিটারের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে। ভবনের উচ্চতা ভেদে এক একটি চুলার জন্য আলাদা লাইন করতে ৭/৮ হাজার টাকা থেকে ১৫/১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে। কোন গ্রাহককে দশটি চুলার লাইন আলাদা করতে হলে বেশ বড় অংকের একটি অর্থ যোগানোর ধকল সামলাতে হচ্ছে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসা বাড়িতে গ্যাসের বিল ভাড়াটিয়া দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে গ্যাস সাশ্রয় হলে ভাড়াটিয়ার উপকার হবে, বাড়ি মালিকের বিশেষ কোন উপকারে আসবে না। তাই বাড়ি বা ভবনের মালিক প্রিপেইড মিটারের জন্য বাড়তি অর্থ খরচের ঝামেলায় যেতে চাচ্ছে না।
গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কার্যক্রমে ইতোমধ্যে ১৫ হাজার মিটার স্থাপন করা হয়েছে। আরো ১১ হাজার মিটার স্থাপনের উপযোগী করে রাইজার থেকে চুলা পর্যন্ত আলাদা লাইন করা ভবন রয়েছে। কিন্তু এর পরে গিয়ে বাকি মিটারগুলো কিভাবে স্থাপিত হবে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেছেন, বাড়ি মালিকদের প্রচন্ড আগ্রহ রয়েছে, তবে বাড়তি খরচের জন্য তারা এগিয়ে আসছে না। ফলে ২৬ হাজার মিটার স্থাপনের পর বাকি ৭৪ হাজার মিটার ঠিকঠাকভাবে স্থাপন করার উপযোগী বাড়ি বা ভবন রেডি হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে অ্যাপার্টমেন্টগুলোর যেখানে গ্যাসের লাইন রয়েছে সেগুলোতে প্রিপেইড মিটার স্থাপন সহজ। তবে শহরের বহু অ্যাপাটমেন্টেই গ্যাসের সংযোগ নেই। এটিও একটি বড় সমস্যা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪শ’ প্রিপেইড মিটার লাগানো হচ্ছে। সম্প্রতি একদিনে ৪৪২টি মিটার স্থাপন করে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে লাইন রেডি না থাকলে মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে না। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী জানান, প্রিপেইড মিটার দেশের গ্যাস সেক্টরের জন্য একটি আশীর্বাদ। কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে। জ্বালানি খাতে গ্রাহকের খরচ অনেক কমে যাচ্ছে। কিন্তু আলাদা লাইন করার যে খরচ এককালীন করতে হচ্ছে সেটাই পুরো প্রকল্পটিকে একটি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।