বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ যা একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃত। মাছটির স্বাদ ও বৈশিষ্ট্যের জন্য অনন্য। নদীতে জন্ম নেওয়া মাছটির বেড়ে উঠা সমুদ্রে। আবার ডিম দিতে ফিরে আসে নদীতে। সম্প্রতি প্রথমবারের মত ইলিশ মাছের ত্বক ও বৃহদন্ত্র বা অন্ত্রের অণুজীবসমূহের (মাইক্রোবায়োম) গঠন ও বৈচিত্র্য উদঘাটন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। গবেষণায় বাংলাদেশে ইলিশ মাছের অন্ত্রের মধ্যে বেশিরভাগ উপকারী অণুজীব পাওয়া গেছে। ক্ষতিকারক তেমন অণুজীব পাওয়া যায়নি।
অন্ত্র অর্থাৎ নাড়িভুঁড়ি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। কারণ মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় ক্ষমতা থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সবই প্রভাবিত হয় অন্ত্রের অবস্থা থেকে। শক্তিশালী এই অঙ্গ আবার প্রচণ্ড সংবেদনশীল। অগণিত ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়া, মাইক্রোঅর্গানিজম নিয়ে অন্ত্রের ‘মাইক্রোবায়োম’ তৈরি হয় যা হজমক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেই ভারসাম্যই হল সংবেদনশীল যা সামান্য বিশৃক্সখলাতেই বিভিন্ন সমস্যা ডেকে আনতে পারে। এই মাইক্রোবায়োম সাধারণত দেহে ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করে তাদের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন, রোগ–প্রতিরোধ এবং পরিবেশের সাথে অভিযোজনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় ৯টি বিভাগ, ৩৫টি বর্গ ও ১২১টি গণের ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়েছে। ত্বক ও অন্ত্রে ৬০ শতাংশের বেশি প্রোটিওব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। অন্ত্রে পাওয়া উল্লেখযোগ্য ব্যাকটেরিয়াসমূহ হলো, সেরাশিয়া, ভিব্রিও, ল্যাক্টোকক্কাস, স্যালমোনেলা, সিউডোমোনাস, প্রিভোটেলা, লিউকোব্যাক্টার প্রভৃতি।
ত্বকের অণুজীবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাইক্রোব্যাক্টার, অ্যাসিনেটোব্যাক্টার, ক্রাইসিওব্যাক্টেরিয়াম প্রভৃতি। ইলিশে পাওয়া উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো হলো সেরাশিয়া, ল্যাক্টোকক্কাস, লিউকোব্যাক্টার, প্রিভোটেলা, সাইক্রোব্যাক্টার প্রভৃতি। ইলিশ মাছে অনন্য স্বাদ, পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি, ছোট শিকলবিশিষ্ট ফ্যাটি এসিড তৈরি, উচ্চ রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিভিন্ন পরিবেশের অভিযোজনে এই সকল ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির সম্পর্ক থাকতে পারে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, লবণাক্ততা ও পানির অণুজীবের বিন্যাস ইলিশ মাছের ত্বক ও অন্ত্রের অণুজীব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভবিষ্যতে ইলিশ মাছের উন্নয়নে এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
গবেষণা প্রবন্ধটি নেদারল্যান্ড এর বিজ্ঞান সাময়িকী ‘মলিকুলার বায়োলজি রিপোর্টস’ এ প্রকাশিত হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই গবেষণা স্বীকৃতি পায়। গবেষকদলের নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. এস এম রফিকুল ইসলাম এবং মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক প্রফেসর ড. এস এম শরীফুজ্জামান। সহ গবেষক ছিলেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক আফরোজা আক্তার তন্বী, ফারজানা শারমিন, প্রফেসর ড. আদনান মান্নান ও মেরিন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. শাহনেওয়াজ চৌধুরী। গবেষণা সহযোগী ছিলেন সবুজ বিশ্বাস। গবেষণা সহযোগিতায় ছিল ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার নোবেল জয়ী গবেষণাগার ব্যারি মার্শাল ল্যাবের আলফ্রেড তাই ও কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাভেদ ফয়সাল। গবেষণাটির জন্য বঙ্গোপসাগরের গভীর অংশ (কক্সবাজার), বঙ্গোপসাগরের মোহনা (চট্টগ্রামের কাট্টলী) এবং পদ্মা (মানিকগঞ্জ) ও মেঘনা (চাঁদপুর) নদী থেকে ইলিশ মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। মেটাজিনোমিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইলিশ মাছের ত্বক ও অন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব শনাক্ত করা হয়েছে।
গবেষক দলের একজন প্রফেসর ড. এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ইলিশ মাছ দুইটা পরিবেশে বাস করে। একটা মিঠা পানি আরেকটা লোনা পানি। এই পানিতে বাস করতে গিয়ে মাছের কোনো পরিবর্তন হয় কিনা বা প্রভাব পড়ে কিনা, সেটি গবেষণায় উঠেছে। অন্ত্র বা পাকস্থলী শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে শুরু করে শরীরের অনেকে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে অন্ত্রের মধ্যে থাকা অণুজীবগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রাখে। গবেষণায় বাংলাদেশে ইলিশ মাছের অন্ত্রের মধ্যে বেশিরভাগ উপকারী অণুজীব পাওয়া গেছে। ক্ষতিকারক তেমন অণুজীব পাওয়া যায়নি।