দুদিন ধরে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হওয়ায় হালদা পাড়ের মানুষজন নড়েচড়ে বসছেন। ডিম আহরণের সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সংগ্রহকারীরা। লাগাতার বজ্রসহ বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে এবং নদীতে ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে হয়তো আগামী অমাবস্যা তিথিতে মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
হালদা গবেষক ক্যান্টনমেনট পাবলিক কলেজের জীব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্র মা মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী কিনা জানতে গত ১ মে বুধবার হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ড সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে সরাসরি হালদা নদীতে ও হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেন পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের (দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বনডাই–অক্সাইড, ক্যালসিয়াম, ট্র্যান্সপারেন্সি, টিডিএস, ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি, লবণাক্ততা, খরতা ও ক্ষারকত্ব ইত্যাদি) আদর্শ মানের মধ্যে রয়েছে। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার পানির তাপমাত্রার আদর্শ মান : ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে ৩৩ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়েছে। মেজর কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। মেজর কার্পজাতীয় মাছের জন্য অত্যানুকূল পানির তাপমাত্রা হচ্ছে ২২–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এরা অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। বৃষ্টিপাত হলে এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। আর তখনই নদীতে ডিম ছাড়বে মা মাছ।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবিএম মশিউজ্জামান জানান, নদীতে মাছের অবাধ বিচরণ ও মাছের মজুদ বৃদ্ধি জীববৈচিত্র্য ও ডলফিন রক্ষা করতে সার্বক্ষণিকভাবে নদীর দুই পাড়ের জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশ, আনসার–ভিডিপি কাজ করে যাচ্ছে। এবার যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকে, হালদায় আশানুরূপ ডিম পাওয়া যাবে। এদিকে নদী থেকে আহরিত ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য সরকারি হ্যাচারিগুলো ইতিমধ্যে সংস্কার ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন করা হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী মিঠাপানির মেজরকার্প জাতীয় মাছের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ক্ষেত্র। এই জলজ বাস্তুতন্ত্রে রয়েছে ৯৩ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি ও গাঙেয় ডলফিন। দেশের অন্যতম এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার তিথিতে বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে পানিতে তীব্র স্রোত সৃষ্টি করে। ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে মা মাছ নদীতে ডিম ছেড়ে থাকে।
প্রত্যেক বছর মৌসুমের সময় ৫০০–৬০০ জন স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী এসব ডিম সংগ্রহ করে মাটির তৈরি কূয়া বা হ্যাচারিতে ফুটিয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পোনা উৎপাদন করে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হালদার মৎস্য সম্পদের উপর। এর প্রভাবে বিগত কয়েক বছর হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমেছে। বর্তমানে হালদা নদীতে চলছে মেজর কার্পজাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা (৫০ বছরের মধ্যে অধিক) ও বজ্রসহ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় বিগত এপ্রিল মাসের দুটি তিথিতে/জো’তে (অমাবস্যার ও পূর্ণিমার) ডিম ছাড়েনি কার্পজাতীয় মা মাছ। দীর্ঘদিন পর বিগত দুই দিন বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হলেও নদীতে ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়নি। লাগাতার বজ্রসহ বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে এবং নদীতে ঢলের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে হয়তো আগামী অমাবস্যা তিথিতে মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।