শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, দৈনিক শ্রমঘন্টা, জীবনধারণ উপযোগী মজুরীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সফল সংগ্রাম– ‘মে দিবস’। ২য় শিল্প বিপ্লবের মধ্য পর্যায়ের ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট সমাবেশ শোষক বুর্জোয়াদের হৃদকম্প সৃষ্টি করেছিল। শোষকদের পেটোয়া গুন্ডা বাহিনী তাদের রক্ষক শাসকগোষ্ঠী অস্ত্রের ভাষায় দমন করার চেষ্টা করে। শ্রমিক হত্যা, নেতাদের গ্রেপ্তার, একতরফা বিচারে নেতাদের ফাঁসিতে হত্যা করা ইত্যাদি কোনোকিছুই শ্রমিক শ্রেণীকে দমাতে পারেনি। এই আন্দোলন পুঁজিবাদের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে তাদের একাধিপত্যকে ভেঙে চুরে দেয়।
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক থেকেই ইউরোপের ইংল্যান্ড, জার্মান, ইত্যালি, ফ্রান্স ইত্যাদি শিল্পোন্নত দেশের সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির অধিকার রক্ষার আওয়াজ উঠতে শুরু করে। সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৮৩২ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত “ওয়ার্ক ম্যান এসোসিয়েশন” সে সময়ের প্রথম শ্রমিক সংগঠন। এর আগেও নির্যাতিত অসংগঠিত শ্রমিকদের স্বতস্ফূর্ত কিছু কিছু আন্দোলন শিল্পোন্নত দেশগুলোতে হয়েছে। প্রাথমিক আন্দোলনের দাবি গুলো ছিল– কর্মঘন্টা কমানো, মজুরি বৃদ্ধি, সর্র্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি। তখন শ্রমজীবী গরীব কৃষক শ্রমিকদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। শুধুমাত্র অভিজাত ধনিক শ্রেণি ভোট দিয়ে সংসদ নির্বাচন করত।
জার্মান দার্শনিক সমাজ বিজ্ঞানী কার্ল মার্কস এ সময় শিল্পোৎপাদনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা, সামাজিক অবস্থান, শ্রমশোষণের চিত্র, পূঁজির মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, মুনাফা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে শ্রমিক শ্রেণির সংঘটিত আন্দোলন ছাড়া শোষণ মুক্তি সম্ভব নয়। মার্কস এংগেলস যৌথ উদ্যোগে দীর্ঘদিন কাজ করে লন্ডন শহরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক নেতাদের এক সভা আহ্বান করা হয়। ঐ সভায় শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৬৪ সালে অনুষ্ঠিত এই সভায় গঠিত সংগঠনের নাম দেওয়া হয় “১ম আন্তর্জাতিক”। জার্মান থেকে নির্বাসিত এই দুই নেতাকে ধনিক শ্রেণির সরকার এক পর্যায়ে বৃটেন থেকেও বহিষ্কার করলে ১৮৭৬ সালের ১ম আন্তর্জাতিকের সদর দপ্তর আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। এই সংগঠনের মূল বক্তব্য ছিল ‘সমাজ শ্রেণি বিভক্ত। পরস্পর বিরোধী শ্রেণিগুলো স্বীয় শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজ করে।’ ১৮৭৬ সালে ১ম আর্ন্তাজাতিকের সদর দপ্তর আমেরিকায় স্থানান্তরের পর সেখানেও শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন সংগঠন বেগবান হয়। তার ধারাবাহিকতায় ১৮৮৬ সালের মে দিবসের শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত হয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৎকালীন পূঁজিবাদের দুর্বলতম দেশ রাশিয়ায় কাল মার্কস’র যোগ্য উত্তরসূরী মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি রুশ বিল্পবের মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করে সর্বপ্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পৃথিবীর বহু দেশ ওপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সহোযোগিতায় স্বাধীনতা লাভ করলেও মাত্র ৭৫ বৎসর পর ৯০’র দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়।
১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ–এশিয়ার বিশাল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, শিল্প কারখানা ধ্বংস, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু দুর্ভিক্ষ হলেও ২য় বিশ্বযুদ্ধের বড় ভাগীদার আমেরিকার ভূখন্ডে একটি গুলিও পড়েনি বরং অস্ত্রের ব্যবসা করে আমেরিকা গোট বিশ্বের সম্পদ বিভিন্ন কায়দায় তার দেশে পাচার করেছে।
পক্ষান্তরে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্টিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ক্রমাগত আমেরিকার আক্রমণাত্মক মনোভাব, অন্তর্ঘাত মূলক কাজ, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার মার্শাল প্ল্যান, গোটা বিশ্বকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্ত শুরু হয়। এসব কারণে নব্য প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দেশসমূহে উৎপাদন যন্ত্রের উৎকর্ষতায় ঘাটতি থেকে যায়। যুব সমাজের তথা সাধারণ মানুষের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি। জনগণের নৈতিকতার মান ও সাংস্কৃতিক মান ধরে রাখা যায় নি। নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে এসব বিষয়ে সঠিক সময়ে উপলব্ধি করতে। বর্তমানে এক মেরুর বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা চতুর্থ শিল্প বিল্পবের যুগ চলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত রোবট নিয়ন্ত্রণ করছে শিল্প উৎপাদন, খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ মহাকাশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একাধিপত্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে মে দিবস কী?
পূর্বের প্রাসঙ্গিকতা বা শ্রমিকদের সংগতি বজায় রাখতে পারছে? আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দেড় শতাব্দী ধরে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার সমূহ একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে। তারা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ওপনিবেশিক শাষন–শোষনের জোয়াল ভেঙে বাঙালি স্বাধীনতা লাভ করে। এ যুদ্ধে এদেশের শ্রমিক–কৃষক, খেটে–খাওয়া মানুষ ও তাদের সন্তানরাই সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জীবন দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
পাকিস্তান টিকে ছিল মাত্র ২৩ বছর কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, কিসিঞ্জারের অভিধাপ্রাপ্ত তলাবিহীন ঝুড়ি শব্দবন্ধকে ডাস্টবিনে ফেলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে জাতিসংঘের সূচকে ২০২৬ সালে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, বিপুল উন্নতি মাথাপিছু গড় আয় ও অন্যান্য সূচকে দেশের প্রভুত উন্নতি হলেও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে রকেটের গতিতে। একদিকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, সমান তালে দুর্নীতি বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট হচ্ছে। ব্যাংক ফাঁকা করে কয়েকশত ধনিক বিদেশে টাকা পাচার করছে। ব্যাংক খেলাপি ও ব্যাংক ঋণ অবলোপনকৃত অর্থের পরিমান অর্থনীতিবিদদের মতে চার লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। বিদেশে পাচারকৃত অর্থের পরিমান প্রায় পৌনে দুই লক্ষ কোটি টাকা। শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়। আমদানির ওভার ইনভয়েসিং রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং বৈদেশিক মুদ্রা দেশে না এনে বিদেশে রেখে দিচ্ছে এইসব পাচারকারীরা। ব্যাংক খেলাপী এবং মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে দেশে কয়েক হাজার কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র্রীয় তহবিল জনগণের সম্পদ তসরুফ হচ্ছে। ধনীদের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে।কয়েক হাজার লুটেরা ফুলে ফেঁপে ওঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধ করেনি।
বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা বলছেন “উন্নয়ন হলেও স্থায়ী দুর্নীতি ও বৈষম্য বেড়েছে। দেশের সিংহভাগ শ্রমজীবি মানুষ এই দুর্নীতি পাচারের সাথে জড়িত নয়। মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন হলেও যারা এই শ্রম দিয়েছেন তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে”। (অর্থনীতিবিদ রিজুয়ানুল ইসলাম; প্রথম আলো; ১৯–০৪–২৪)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম.এম আকাশ বৈষম্য প্রসঙ্গে এক সেমিনারে বলেন, “দারিদ্রের হার কমেছে, কিন্তু বেড়েছে বৈষম্য। গরীবের উন্নতি শামুকের গতিতে হয়েছে আর ধনীদের রকেট গতিতে। অন্যদিকে শ্রমিকের গড় উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে সেভাবে মজুরি বাড়েনি”। (প্রথম আলো; ১৯–০৪–২৪)
দীর্ঘ দেড় শতাব্দী ধরে বিশ্বব্যাপি শ্রমজীবী মানুষ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো– তা আজ হারাতে বসেছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে উন্নত প্রযুক্তির রোবোটিক উদ্ভাবন উৎপাদন সেবা কাজে রোবটের ব্যবহারের ফলে বহু মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, অপ্রাতিষ্টানিক খাতের শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রাতিষ্টানিক সেবা কৃষিখাতে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ শ্রম দিচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ শ্রমিক অপ্রাতিষ্টানিক খাতে কাজ করে। গার্মেন্টস, বেসরকারি সাস্থ্য সেবা, হোটেল, বেকারী, কেমিক্যাল, জাহাজ ভাঙা শিল্প নির্মাণ, রেলবন্দর প্রাতিষ্টানিক খাত হলেও ক্রমান্বয়ে মালিক কর্তৃপক্ষ কনট্রাকটরি প্রথায় মধ্যস্বত্ত ভোগির মাধম্যে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরী দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। এসব প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও দেশের বিদ্যমান শ্রম আইনের প্রয়োগ, নিম্নতম মজুরী জীবনধারনের মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আইন মোতাবেক ওভারটাইম ভাতা না পেয়েও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে শ্রমিকরা উপরিআয়ের জন্য দৈনিক ১৪/১৬ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হন। শ্রম আইন বর্ণিত সবেতন ছুটি নিয়োগপত্র দেওয়া হয়না। প্রভিডেন্ট ফান্ড লভ্যাংশের কথা বলা বাহুল্য। আমাদের দেশের শিল্পপতি মালিকরা উপলব্ধি করেন না যে খেয়ে–পড়ে বেঁচে থাকা শিক্ষা–চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্ত সন্তুষ্ট শ্রমিক দিয়েই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু মালিক কর্তৃপক্ষের চেষ্টা থাকে শ্রম আইনকে কিভাবে শ্রম শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করা যায়। কিভাবে শ্রম আইনে বর্ণিত অধিকার ক্রমশ খর্ব করে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা যায়। উন্নয়ন উৎপাদনের সুফল শ্রমজীবী মানুষ সৃষ্ট সম্পদ, রাষ্ট্রের তহবিল দিয়ে নিজেদের ঝুলি ভর্তি করা যায়। কায়িক শ্রমের জায়গা ক্রমান্বয়ে দখল করছে যন্ত্র বা রোবট। ফলে আমাদের মতো জনবহুল দেশে কায়িক শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হচ্ছে।
কর্তাব্যক্তিরা বলেন বাংলাদেশের শ্রম আইন একটি শ্রম বান্ধব আইন। বস্তুত এই আইনের শ্রমিক অধিকার ক্রমান্বয়ে খর্ব করা হচ্ছে। এই আইন শ্রম বান্ধব নয় বরং পুঁজি বান্ধব আইন। তাই বলি মে দিবস ক্রমান্বয়ে তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে। অর্জিত অধিকার ক্রমান্বয়ে শ্রমজীবি মানুষের হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
কর্পোরেট পুঁজি, ব্যক্তি পুঁজি, আমলাদের মেল–বন্ধনে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার খর্বিত হচ্ছে। কোনো কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেতা পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারীদের বক্তব্যের প্রচারকের দায়িত্ব নিয়েছে।
তাই মে দিবসের মূল চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে শ্রমের ন্যায্য মজুরি আন্তর্জাতিক ও দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী আট ঘন্টা কর্মদিবস, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ, কন্ট্রাকটর প্রথা বাতিল, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্টা ছাড়াও জাতীয় স্বার্থে দুর্নীতি, লুটপাট, পুজিঁপাচার বন্ধ, নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মূল্য কমানোর স্বার্থে সুস্থ ধারার ট্রেড ইউনিয়ন ও আন্দোলন গড়ার শপথ হোক এবারের মে দিবসের শপথ।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি।