চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পাঁচ দিন পর গতকাল সোমবার প্রথম কার্যালয়ে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ। কার্যালয়ে যোগ দেয়ার প্রথম দিনেই তিনি সিডিএ’র কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং সকলকেই দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের গাফিলতি না করার নির্দেশ প্রদান করেন। গতকাল সোমবার ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল ৯টায় সিডিএ ভবনে পৌঁছান নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনূছ। যোগদান করেই তিনি জানিয়েছিলেন যে কেউ যাতে ফুল দিতে এসে তাকে বিব্রত না করেন। সেজন্য একেবারে অনাড়ম্বরভাবেই তিনি সিডিএতে আসেন। সিডিএ ভবনে পৌঁছে নিজের কক্ষে যাওয়ার আগে তিনি প্রতিটি প্রতিটি বিভাগীয় ও শাখা অফিস ঘুরে দেখেন। পরে তিনি নিজের কক্ষে গিয়ে বসেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন।
মতবিনিময়কালে সিডিএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, অস্ত্র হাতে ট্রেনিং পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে অন্য কারও সঙ্গে মেলালে ভুল করবেন। অফিস টাইম সকাল ৯টায়। সবাইকে সময় মতো অফিসে আসতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে হবে দেশপ্রেম, সততা এবং আন্তরিকতা দিয়ে। কোনো ধরনের গাফিলতি আমি মেনে নেব না। চেয়ারম্যান হয়েছি বলে আমি এসি রুমে বসে থাকব মনে করলে ভুল করবেন।’
পরে তিনি সিডিএ’র বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে কয়েকজন রাজনৈতিক শুভাকাঙ্ক্ষী তার সাথে দেখা করেন। তবে গতকাল পুরোদিনেই কোনো নেতাকর্মীর ভিড় ছিল না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র গিয়াস উদ্দিন সিডিএ ভবনে গিয়ে নতুন চেয়ারম্যানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক উপকমিটির সদস্য নুরুল আজিম রনিসহ কয়েকজন কার্যালয়ে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানান। বিকেল সাড়ে ৪টায় চেয়ারম্যান কার্যালয় ত্যাগ করেন।
গতরাতে দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে সিডিএর নয়া চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘আমি ঠিক সকাল ৯টায় অফিসে পৌঁছাই। তবে নিজের রুমে ঢোকার আগে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রত্যেকের রুমে গিয়েছি। কে উপস্থিত, কে অনুপস্থিত সেটা যাচাই করেছি। এরপর তাদের সঙ্গে মিটিং করে আমার মেসেজ জানিয়ে দিয়েছি। উনারা সবাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে যে দেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সেই দেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতিটি কর্মে দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সিডিএর কর্মকর্তা কর্মচারীদের যেমন সরকারের প্রতি জবাবদিহিতা থাকবে, তেমনি ত্রিশ লাখ শহিদ এবং সৃষ্টিকর্তার কাছেও থাকতে হবে। এসব বিষয় আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছি, আমি শুধু চেয়ারম্যান নই, আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সবাই মিলেমিশে এ শহরকে আমরা বাসযোগ্য করব। আমি কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে চাই না, কিন্তু কেউ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করতে পারবে না। এটা আমি বরদাশত করবো না’।
উল্লেখ্য, সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদের শেষদিন গত ২৪ এপ্রিল নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছকে নিয়োগ প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ওইদিন বিকেলেই তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে গিয়ে যোগদান করেন। এরপর তিনি ঢাকায় একাধিক মিটিংয়েও যোগ দেন। গতকালই প্রথম তিনি নিজের অফিসে আসেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে রাজনৈতিক নিয়োগ শুরু হয় ২০০৯ সালে। ওই সময় সিডিএ চেয়ারম্যান পদে প্রথম রাজনৈতিক নিয়োগ পান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম। বেশ কয়েক দফায় তিনি টানা ১০ বছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি চান্দগাঁও–বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য।
২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় নগর আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষকে। মেয়াদ বাড়ানোর পর তিনি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হাটহাজারীর সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ সাবেক নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর ভাবশিষ্য। সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য।
একসময় উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দীর্ঘসময় রাজনীতিতে তিনি পদ–পদবিবিহীন অবস্থায় থাকেন। তবে বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদের মহাসচিব। চট্টগ্রামে সিআরবিতে প্রাণ–প্রকৃতি ধ্বংস করে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে যে কজন মানুষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ অন্যতম।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য তিনি সমধিক খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মোছলেম উদ্দিন আহমদ এবং ইউনুছ মিলে চট্টগ্রামে তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডারের বাসভবনে দুঃসাহসিক আক্রমণ চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। বন্দি অবস্থায় অমানবিক নির্যাতন সয়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ‘পাগল’ সেজে হানাদার বাহিনীর বন্দিশালায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে চলে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিশোধ নিতে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে যে ক’জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, ইউনুছ তাদের একজন। এজন্যও তাকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও কখনো কোনো পদপদবীর ধারে কাছে ছিলেন না। অবশেষে সরকার এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সম্মানিত করলো।