ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার
আল কুরআনে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা: আল্লাহ তা’আলা কর্মের ও শ্রমের মাধ্যমে অবস্থার উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কঠোর শ্রম একটি জাতির ভাগ্যন্নোয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আমি মানুষকে কঠোর কষ্ট ও শ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা: আল বালাদ, ৯০:৩)
শ্রমজীবি মেহনতি লোকেরা মহান আল্লাহ তা’আলার দয়া ও কৃপায় আল্লাহর সৃষ্ট জমিতে চাষাবাদ করবে, জমিকে উৎপাদনের উপযোগী করবে এবং জমি থেকে অধিক ফসল ফলানোর জন্য নিজেদের চেষ্টা ও শ্রম নিয়োগ করবে। বান্দা আল্লাহর অনুগ্রহে নিজের শ্রম নিয়োগ করে ফসল উৎপাদনে পরিশ্রমী ভূমিকা পালন করার দিকে আল্লাহ তা’আলা ইঙ্গিত করেছেন, এরশাদ করেছেন, “আর উৎকৃষ্ট ভূমি যার ফসল তার প্রতিপালকের আদেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে কঠোর পরিশ্রম না করলে কিছুই হয়না।” (সূরা: আ’রাফ, আয়াত: ৫৮)
শ্রম ছাড়া আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, ইসলাম পরিশ্রমী ও কর্মঠ লোকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছে, কর্ম বিমূখ অলস ব্যক্তিকে ইসলাম ঘৃণা করে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর এই যে মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে।” (সূরা: নাজম, আয়াত: ৩৯)
বিশ্বস্ত ও আমানতদার শ্রমিকই আদর্শ শ্রমিক: ব্যক্তি পর্যায়ে সামাজিক ক্ষেত্রে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উন্নয়ন ও অগ্রগতিরধারা অব্যাহত রাখতে মালিক শ্রমিকের পারস্পরিক সুসম্পর্কের গুরুত্ব অপরিহার্য। একজন শ্রমিক তখনই মালিকের আস্থাভাজন হয়ে থাকেন যদি শ্রমিকের মধ্যে মালিকের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে কোনো প্রকার শৈথিল্য অবহেলা অলসতা দূর্নীতি ও অপরাধপ্রবণতা কাজ না করে শ্রমিক হবেন একান্ত নিষ্ঠাবান কর্মঠ নিবেদিত মালিকের স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিক বিশ্বস্ত ও আমানতদার। পক্ষান্তরে মালিকও হবেন শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ে যত্নবান সচেষ্ট ও ন্যায়পরায়ন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আপনি যাদেরকে শ্রমিক নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত।” (সূরা: কাসাস: ২৮:২৬)
দু:খ জনক হলেও বাস্তব সত্য যে, আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় সবচেয়ে অবহেলিত ও নির্যাতিত শ্রেণি হলো শ্রমিক শ্রেণি। যাদের অক্লান্ত ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে দেশে বিদেশে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বস্তরে উন্নয়ন অগ্রগতি দৃশ্যমান তারা আজ সর্বত্র নিগৃহীত অধিকার বঞ্চিত, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের সাথে মালিকদের বিমাতাসূলভ আচরণ বর্তমান সমাজে শ্রমিকদের কে তাদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য রাজপথে আন্দোলন করতে হয়।
হাদীস শরীফের আলোকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার: ইসলামই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সার্বজনীন কালোত্তীর্ণ জীবন দর্শন যে পবিত্র ধর্মে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আদর্শ ও সাম্যমৈত্রী প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।
শ্রমিকের প্রতি বৈষম্যহীন আচরণের শিক্ষা: মানবতার নবী বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে ন্যায় নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার অনন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ শ্রমিকের প্রতি সদাচরণ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু যর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তারা (তোমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা) তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তা’আলা তাদের তোমাদের অধীনস্থ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কারো ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকে তা থেকে পরিধান করতে দিবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সে কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয় তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে। (বুখারী, হাদীস: ৬০৫০, মুসলিম, হাদীস: ১৬৬১)
শ্রমিকের যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান করা অপরিহার্য: শ্রমিকের যথার্থ পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের অপরিহার্য কর্তব্য। তাকে ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিক প্রদানে গড়িমসি করা, তালবাহানা করা, হয়রানি করা, অনৈতিক কাজ। শ্রমিককে তার যোগ্যতা ও শ্রম অনুযায়ী প্রচলিত নিয়মে তার পারিশ্রমিক তাকে যথাসময়ে প্রদান করা জরুরি। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “ প্রত্যেকের জন্য তাদের কাজ অনুসারে মর্যাদার স্তর, তাদের কাজের প্রতিফল তাদের দিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবেনা। (সূরা: আহকাফ, ৪৬:১৯)
যথাসময়ে শ্রমিকের বেতন ভাতা প্রদান করা জরুরি: শ্রমিকের মজুরি পরিশোধে কালক্ষেপন না করে ত্বরিৎ প্রদান করার জন্য ইসলামে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নিয়োগ দান, যোগদানের পূর্বে তার বেতন সম্মানি নির্ধারন করা জরুরি, যাতে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়। কাজের প্রতি যাতে সর্বদা মনোযোগী ও আগ্রহী থাকে কোনো প্রকার চিন্তা ও পেরেশানি যাতে অনুভব না করে আলোচনা সাপেক্ষে দৈনিক/ মাসিক বেতন যথাসময়ে প্রদান করা জরুরি। লিখিত/ অলিখিত চুক্তি অনুসারে শ্রমিকের পূর্ণ বেতন যথাসময়ে প্রদান করা মালিকের উপর অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানোর পূর্বে দিয়ে দাও। (সুনানু ইবনে মাযাহ, হাদীস: ২৪৪৩)
শ্রমিকের কোন পেশাকে তুচ্ছ করে দেখা যাবেনা: ইসলামে প্রত্যেকটি শ্রমের গুরুত্ব রয়েছে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রত্যেক সম্মানিত নবী রাসূল গণ একেকটি পেশা অবলম্বন করেছেন, কুরআন সুন্নাহ পর্যালোচনায় দেখা যায় প্রত্যেক নবী রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম দৈহিক পরিশ্রম করে হালাল পন্থায় জীবিকা উপার্জন করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম কৃষি কাজের সূচনা করেছেন, হযরত দাউদ (আ.) লৌহবর্ম তৈরী করতেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজের দুহাতের উপার্জন ছাড়া খেতেন না। (বুখারী, হাদীস: ২০৭৩)
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ দিন নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। হযরত নুহ আলাইহিস সালাম জাহাজ শিল্পের কাজ করতেন। হযরত ইদরীস আলাইহিস সালাম বস্ত্র সেলাইয়ের কাজ করতেন। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম বকরী পরিচালনার কাজ করতেন। আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “এটি আমার লাটি আমি এর ওপর ভর করি, এটি দিয়ে আমি আমার মেষ পালের জন্য গাছের পাতা পাড়ি এবং এটি আমার আরো অনেক কাজে লাগে।” (সূরা: তাহা, ২০:১৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক যে কোনো কাজ করতে লজ্জাবোধ করতেন না, নিজের কাজ নিজেই করতেন, নিজ সহধর্মিনীদের পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করতেন, দুধ দোহন করতেন, ঘর পরিষ্কার করতেন, বাজার থেকে পণ্য সামগ্রী বহন করে আনতেন। খন্দক যুদ্ধের দিন মাটি বহন করেছেন। সাহাবাগণ পরিখা খনন করছেন এমন সময় তিনি কর্মস্পৃহায় গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহ ব্যঞ্জক কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। এভাবে সম্মানিত সাহাবাগণ প্রত্যেকে জীবনে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। প্রত্যেকে শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে ইতিহাসে বহু খ্যাতিমান মুজতাহিদ ইমামগণ, ইসলামী আইনজ্ঞ ফকীহ ও আলিমগন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত হওয়া সত্বেও নিজের নামের সাথে পেশার পরিচয় যুক্ত করে দেয়াকে গর্ববোধ করতেন। আমাদের মাযহাবের মহান ইমাম হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহ একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। শ্রম বিমূখ হয়ে অন্যের করুণা ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল থাকা নৈতিকতা নয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কারো জন্য নিজের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম কোন আহার নেই। (বুখারী)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রম জীবী ও পেশাজীবী মানুষদের কে আল্লাহর বন্ধুত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। নবীজি খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা প্রসঙ্গে এরশাদ করেন, উপার্জনকারী শ্রমিক হলো আল্লাহর বন্ধু। (কানযুল উম্মাল, পৃ: ১২৭)
নবীজি ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার শিক্ষা দিয়েছেন এ জন্যই নবীজি এক দরিদ্র ভিক্ষুক সাহাবীর হাতে কুড়াল নিজ হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন যাও, পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে আনো এবং বিক্রি করো আর আমি যেন তোমাকে পনের দিন পর্যন্ত না দেখি। পনের দিনে দশ দিরহাম উপার্জন করে আনসার সাহাবী আনন্দচিত্তে নবীজির খিদমতে উপস্থিত হলেন। অত:পর নবীজি তাঁেক বললেন, কিয়ামতের দিন তোমার চেহারায় ভিক্ষার দাগ থাকবে এর চেয়ে এই শ্রমের উপার্জন তোমার জন্য অনেক উত্তম। (আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
নিজের শক্তি সামর্থকে অনর্থক নষ্ট করে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসানো ইসলাম সমর্থন করেনা। ইসলামের আবেদন হলো “নবীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা, মেহনত করো সবে।”
আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেককে শ্রম দ্বারা হালাল উপার্জন করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।