গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। একদিকে তীব্র গরম অন্যদিকে দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ে মানুষের যন্ত্রণা চরম আকার ধারণ করেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, তীব্র গরমে মানুষের যখন বেহাল দশা তখন বাংলাদেশ জুড়ে লোডশেডিংও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাকাল হচ্ছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। এর ফলে মানুষ দৈনন্দিন কাজও করতে পারছে না স্বাভাবিকভাবে। সবার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে লোডশেডিংয়ের কারণে। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ থাকছে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা বাকি সময় গ্রীষ্মের উত্তাপে বেগ পেতে হচ্ছে এলাকাবাসীদের। লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে দেখা দিচ্ছে জ্বর, সর্দি, কাশিসহ নানান অসুস্থতা যা নবজাতক থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত ভোগ করছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অসম্ভব গরমে দিনে কষ্ট সহ্য করতে পারলেও রাতে বিছানায় পিঠ ঠেকতেও কষ্ট হচ্ছে মানুষের, ঠিকভাবে ঘুম হচ্ছে না তাদের। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের জরুরি কাজও।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ। গরম এভাবে চলতে থাকলে লোডশেডিং আরো বাড়বে। পাশাপাশি বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৭ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা আরো বাড়তে পারে। তাতে লোডশেডিংও আরো বাড়বে। এদিকে বর্তমান চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। ফলে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে। এই বিপুল ঘাটতি সরকার জেলা ও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং করে সমাধানের চেষ্টা করছে। এতে ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, এ বছর গরমে চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন রয়েছে। জ্বালানি তথা তেল, গ্যাস ও কয়লার সরবরাহ না বাড়ালে তখন লোডশেডিংজনিত সংকট আরও বাড়বে। পাওয়ার সেলের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৬৭ মেগাওয়াট। পিডিবি’র কর্মকর্তারা বলেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম হওয়ায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দৈনিক অন্তত ২৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই চাহিদামাফিক গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে সক্ষমতার অর্ধেকও উৎপাদন হচ্ছে না। পিডিবি জানিয়েছে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারার প্রধান কারণ, তাদের হাতে অর্থ নেই। সংস্থাটির কাছে সরকারি–বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি, বেসরকারি ও দেশি–বিদেশি যৌথ কোম্পানির পাওনা ৩৭ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। আর পেট্রোবাংলার অধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাওনা ৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ডলার–সংকটের কারণে এই পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার–সংকট মোকাবিলা করতে না পারলে চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ নিয়ে অস্বস্তিতে থাকবে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ার পরও প্রতিদিনই কয়েক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোয় দেখা দিয়েছে এই সংকট। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুত থাকার পরও জ্বালানিকে আমদানিনির্ভর করে তোলা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বসিয়ে বসিয়ে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই ভুল এবং কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার এই নীতির কারণেই আজকে লোডশেডিংয়ের এই চরম পরিস্থিতি। গ্যাস, কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম পত্রিকান্তরে বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছিলাম, সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ঠিকই, কিন্তু বিদ্যুৎ দিতে পারবে না। কারণ, প্রতিযোগিতা ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, এর ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এসব অর্থ পরিশোধের ক্ষমতা পিডিবির নেই। এখন কেন্দ্র বসে থাকবে, সেই বসে থাকা কেন্দ্রের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু মানুষ গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাবে না।’ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় নিতে হবে নিজস্ব উদ্যোগ। লোডশেডিং পরিস্থিতির অবনতি দ্রুত রোধ করতে হবে।