আজ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ম্যালেরিয়া মশাবাহিত সংক্রামক রোগ। এ রোগের মূলে রয়েছে ‘প্লাজমোডিয়াম’ গোত্রের একধরনের পরজীবী। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল যেখানে গরম ও আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি, সেসব অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্য মতে, দেশের মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের ৯৩ শতাংশই তিন পার্বত্য জেলায়। ২০০১ সালে ম্যালেরিয়া দিবস প্রথম পালন করা হয় আফ্রিকা ম্যালেরিয়া দিবস হিসাবে। এর পর ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলির ৬০তম অধিবেশনে এই দিবসটির প্রস্তাবনা করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস পালিত হয়ে আসছে।
উইকিপিডিয়ায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ম্যালেরিয়া শব্দের অর্থ দূষিত বাতাস। ম্যালেরিয়া হলো মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের একটি মশা–বাহিত সংক্রামক রোগ যার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্টা (এক ধরনের অণুজীব) ।
১৮৮০ সাল নাগাদ চার্লস ল্যাভেরন লোহিত রক্ত কণিকা থেকে ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে একটিমাত্র কোষবিশিষ্ট পরজীবী প্রোটোজোয়াকে চিহ্নিত করেন। ফলে শত বছর ধরে চলা দূষিত বায়ু সেবনের ফলে রোগ সৃষ্টির ভুল ধারণার অবসান ঘটে। ১৮৯৭ সালে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে তাকে ১৯০২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দক্ষিণ এবং উত্তর–পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭১টি উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগের মারাত্মক প্রাদুর্ভাব রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ম্যালেরিয়াপ্রবণ এবং কক্সবাজার মধ্য ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে আগের তুলনায় ম্যালেরিয়ার প্রভাব অনেক কমেছে।
ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, ‘মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারি, অ্যারোসল স্প্রে, মশার কয়েল, প্রতিরোধক ক্রিম ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়া লম্বা হাতার জামাকাপড় পরা, সন্ধ্যার পূর্বে ঘরের জানালা বন্ধ রাখা, দরজা–জানালায় নেট ব্যবহার করা, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় এবং জলাবদ্ধ জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, কোথাও যেন পানি জমে মশার বংশবিস্তার ঘটতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর টিকা এখনো বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত নয়। কাজেই অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। ম্যালেরিয়া রোগে অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হলো সময়মতো রোগ শনাক্ত না হওয়া এবং চিকিৎসায় বিলম্ব। সে জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে, জটিলতা সৃষ্টির আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।’
চিকিৎসকরা বলেন, ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার জটিলতা সবচেয়ে বেশি। রক্তের লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করার ক্ষমতা অধিক বলে অন্য প্রজাতির তুলনায় অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতার পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। এমনকি মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। ম্যালেরিয়া রোগের জটিলতম ধরন হলো ‘ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়া’। তাঁরা বলেন, দ্রুত সঠিক চিকিৎসা শুরু করা না হলে মারাত্মক রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, মস্তিষ্কে প্রদাহ, কিডনির সমস্যা, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, অচেতন হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব লাল হওয়া, রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, খিঁচুনির মতো জটিলতা প্রকাশ পায় এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, সচেতন থেকে মশার কামড় থেকে দূরে থাকতে পারলে এ রোগ সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। তাঁরা বেশ কিছু পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। তার মধ্যে রয়েছে, দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে; ঘরের আশপাশে, ফুলের টবে, খালি ড্রামে, ড্রেন, জলাবদ্ধ এলাকায় পানি জমে যেন মশা বংশ বিস্তার করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে মশাবহুল স্থানে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। দরজা–জানালায় মশারোধী জাল এবং শরীরে প্রতিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা দরকার।