জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ জন আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিশোরী বলে জানা গেছে। তাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে পরীক্ষায় ফেল করা কিংবা আশানুরূপ ফল না করাকে দায়ী করা হয়। অন্যদিকে, ২০ এপ্রিল প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। আইনের চোখে আত্মহত্যা একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও তার প্রভাব পড়ছে না সমাজে। চিকিৎসকদের মতে, মানসিক বিষণ্নতা থেকেই মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। মানসিক বিষণ্নতা তৈরির পেছনে কাজ করে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, সিজোফ্রেনিয়া, প্রিয় মানুষটির মৃত্যু, মাদকের ছোবলসহ নানাবিধ কারণ। নিজের কাছে, পরিবার ও সমাজের কাছে নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে গিয়েই মানুষ পা বাড়াচ্ছে আত্মহত্যার দিকে।
কিন্তু কেন বাড়ছে আত্মহত্যা? এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানীং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মাবাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। অভিভাবকদের এই অতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাভিলাষের কারণেই বোর্ড পরীক্ষায় পাস না করায় কিশোর কিশোরীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে বলে তাঁরা জানান।
আজাদীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যার যেসব কারণ উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, উত্ত্যক্ত করা ও প্ররোচিত আত্মহত্যা, প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা, মানসিক অসুস্থতা, জটিল শারীরিক রোগ যন্ত্রণা থেকে আত্মহত্যা, নগরায়ণ ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি ও নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না করার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা সাধারণত ইউডি (আননেচারাল ডেথ বা অপমৃত্যু) হিসেবেই যবনিকাপাত ঘটে। এছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে যদি আত্মহত্যার মামলাগুলো তদন্ত করা যায় তাহলে বেশির ভাগ আত্মহত্যার প্ররোচণাকারীদেরই শনাক্ত করা সম্ভব। তবে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আইনের এই ধারাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা জানাচ্ছে, বিশ্বে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের প্রতি ৬ জনে অন্তত একজনের মাঝে এই তিনটি বিষয়ের যে কোনও একটি আছে। কৈশোরে আত্মহত্যা প্রবণতা থাকা যেমন ভবিষ্যতে আত্মহত্যা করাকে ইঙ্গিত করতে পারে; তেমনি এটি কিশোর–কিশোরীদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। আবার বিভিন্ন মানসিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাও একজনের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করতে পারে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ছেলেদের আত্মহত্যার হার বেশি। কিন্তু মধ্যম আয় আর নিম্ন আয়ের দেশে এই হার সমান–সমান বলেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে অবহেলা, অপমান, কটূক্তি, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, সহিংসতা ও প্রতিযোগিতামূলক তুলনা, এসব নানা কারণে শিশু–কিশোররা হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। বলতে গেলে উল্টো কটু কথা শুনতে হয়। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুর কথা চিন্তা করে থাকে তারা। একসময় তারা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাবা–মা, ভাই–বোন বা পরিবারের সদস্যদের উচিত, কাউকে অবহেলা না করা। পারিবারিক সহিংসতা বা ঝগড়া–বিবাদ ছোটদের সামনে না করা। সন্তানদের কথা শুনতে হবে, তাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত নিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শুধু মনোচিকিৎসক কিংবা মনোবিজ্ঞানী নয়, সবাই মিলে দায়িত্ব নিলে অনেকাংশে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, নিজের মধ্যে আত্মহত্যাপ্রবণতা আসতেই পারে। তখন কিছু কাজ করলে অন্যের সাহায্য ছাড়াও আত্মহত্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ সম্ভব। এক্ষেত্রে আত্মহত্যার ওয়ার্নিং সংকেতগুলো চিনতে হবে। নিজের ইতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলো খাতায় লিখে তালিকা করে বারবার দেখতে হবে। সামাজিক সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজন, বিশেষ করে যারা বিপদের সময় সহায়তা করতে পারবেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে মানসিক স্বাস্থ্য প্রফেশনালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।