কতশত কবি, সাহিত্যিক, পদাবলী লেখক জন্মেছেন স্মৃতির শহর এই চট্টগ্রামে। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির প্যাচানো সিঁড়ির মতো কবিরাজ বিল্ডিং, সদরঘাটের পি.কে সেনের সাত তলা ভবনের ঘোরানো–প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে ভারতবর্ষের পূবপ্রান্তের রূপকথার চরিত্রের মতো সেসব প্রিয়মুখ মনে পড়ে। সে মুখগুলো দেখিনি কোনোদিন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। পুরাকালেও বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবস্থান ছিল সবার উপরে। মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমান কবিদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। এঁদের মধ্যে কবি দৌলত কাজী, আলাওল ছিলেন আরাকান রাজসভার কবি। বলা হয়ে থাকে এদের কারণে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটে। এছাড়াও জন্মেছেন মধ্যযুগের শেখ মুত্তালিব (সীতাকুণ্ড), সৈয়দ সুলতান(পটিয়া), আবদুল হাকিম, মুজম্মিল, বদরুদ্দিন, আকবর, নুরমাহাং, জীবন আলী, চম্পাগাজী, হাসমত আলী, ছিদ্দিক, ছাদেক আলী, সরবিদ খাঁ, সেখ ফয়জউল্লা, সেরবাজ প্রমুখ।
পরাগলী মহাভারত প্রণেতা গঙ্গাদাস সেন (কবীন্দ্র পরমেশ্বর)-এর বাড়ি আনোয়ারায়। পটিয়ার বাসুকী সেন বংশীয় গঙ্গাদাস সেন বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় মহাভারত লেখেন। সঞ্জয় ও জৈমিনির মতাবলম্বনে গঙ্গাদাস সেন বাংলা ভাষায় দু’খানা আঠার পর্বের মহাভারত লিখেছেন। তাঁর লেখা আরও অনেক পুঁথি আছে। পরাগলী মহাভারত গ্রন্থের গঙ্গাদাস সেনের আরও দুজন সহ–লেখক ছিলেন। তাঁরা হলেন রাজেন্দ্র দাস, নিত্যানন্দ ঘোষ। কবি রাজেন্দ্র দাস জামাইজুরির মজুমদার বংশের পূর্বসূরী। কবি নিত্যানন্দ ঘোষের বাড়ি কারো কারো মতে, জামাইজুরি, কারো কারো মতে আনোয়ারার পাটনীকোটা। তাঁরা হোসেনশাহ’র সেনাপতি পরাগল খাঁনের আদেশে মহাভারত লিখেছিলেন। তাই এ মহাভারতের নাম হয় পরাগলী মহাভারত। তাঁরা ১৫০২ থেকে ১৫২২ খৃষ্টাব্দে পরাগলী মহাভারত রচনা করেছিলেন। ভারতে বর্ধমান জেলার কবি কাশীরাম দাস তখন জন্মগ্রহণ করেননি। কাশীরাম দাস গঙ্গারাম সেনের প্রায় একশত বছর পরের কবি। এছাড়াও কাশীরাম দাস মহাভারতের মাত্র চার–পাঁচ পর্ব রচনা করছিলেন। পরের পর্বসমূহ কে বা কারা রচনা করেছেন, সে নাম এখনও জানা যায়নি। সুতরাং চট্টগ্রামের গঙ্গাদাস সেন বাঙলা মহাভারতের আদিকবি। শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি লিখেছেন, গঙ্গাদাস সেনের লেখা মহাভারত পশ্চিমবঙ্গে অনেকে নকল করে নানা নামে প্রকাশ করেছেন। এজন্য লেখকরা প্রতিবাদলিপি পাঠালে তাও নাকি ছাপাতো না।
প্রাচীনকালে চট্টগ্রামে অনেক পুঁথি যৌথভাবে রচনা হতো। এটা তখনকার সময়ের একটা রেওয়াজ ছিল। যেমন বাইশ কবির মনসা পুঁথি, ষাট কবির মনসা পুঁথি। মনসা পুঁথিতে রাজেন্দ্র দাস ও গঙ্গাদাস সেনের নাম আছে। এছাড়া রঘুনাথ, যদুনাথ, বলরাম দাস, নারায়ন দেব, বৈদ্যজগন্নাথ, বংশীবদন, বল্লঘোষ, হৃদয়, গোপীচন্দ্র, গোবিন্দ, জানকী নাথ, রমাকান্ত, বিজয়গুপ্ত, কেতকাদাস, অনুপচন্দ্র, রাধাকৃষ্ণ, হরিদাস, কমলনয়ন, সীতাপতি, রামনিধি, রাজেন্দ্র দাস, ষষ্টিবর সেন প্রমুখ কবি চট্টগ্রামের বলে উল্লেখ আছে।
চৌদ্দ শতকে চট্টগ্রামের রাঘব দাস ‘মোহমুদগর’, অদ্ভুতাচার্য্য রামায়নের ‘সুন্দরাকান্ড’ প্রথম বাংলা পদ্যে রচনা করেন। ভবানী দাস রামের স্বর্গারোহণ বাংলা পদ্যে অনুবাদ করেন। রাধাকান্ত দেব ‘কর্ণমুণির পারণ ভঙ্গ’, জগদীশ সিংহ ‘ভূমিকম্প’, মুক্তারাম দাস ‘উদ্ধব সংবাদ’ রচনা করেছেন। পদাবলী লেখক চন্ডী দাসের বাড়ি চট্টগ্রামে বলে অনুমান করা হয়। তাঁর অনেক পদে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করেছেন গবেষকগণ। আঞ্চলিক শব্দসমূহের মধ্যে আছে–বিচারিয়া, চিৎ হইয়া, আগুলিয়া, জুড়িল, আইজ, কাইল ইত্যাদি।
সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিম মধ্যযুগে লিখেছিলেন-‘ যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। / নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’ তিনি ১৬৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কবির আটটি কাব্যগ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বাংলা ভাষাকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে মধ্যযুগের যেকজন কবি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম পটিয়ার সৈয়দ সুলতান। তিনি ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে নবী বংশ, ইবলিশনামা, শব–ই–মিরাজ, রসুল বিজয়, জয়কুম রাজার লড়াই, জ্ঞান চৌতিশা।
কবি দৌলত কাজী ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আটত্রিশ বছরের জীবনকালে যেসব কাব্য রচনা করেছেন, তার জন্য গবেষকগণ তাঁকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের আসনে সমাহীন করেছেন। আরাকান রাজা শ্রীসুধর্ম’র সমরসচিব আশরাফ খানের নির্দেশে দৌলত কাজী ‘সতী–ময়না ও লোরচন্দ্রানী’ রচনা করেন। আশরাফ খানের বাড়ি হাটাহাজারীর চারিয়া গ্রামে। দৌলত কাজী দ্বিতীয় খন্ড অসমাপ্ত রেখে মৃত্যুবরণ করেন। দাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পর কবি আলাওল দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড সমাপ্ত করেন।
কবি আলাওল সম্পর্কে নানান মত আছে। আলাওল জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের ছিলেন না। তিনি লিখেছেন, ‘হই পরদেশী আমি আলওল হীন। রোসাংএ হইনু বন্দী আপনা কুদিন।’ আলাওল চট্টগ্রামকে রোসাং নামে ডাকতেন। পদ্মাবতী আলাওলের কোনো মৌলিক রচনা ছিল না। এটি তিনি অনুবাদ করেছিলেন। এমন কথা তাঁর বয়ানেও পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন-‘এবে পুস্তকের কথা কর অবগতি। সেখ মহাক্ষদকৃত পুঁথি পদ্মাবলী।।/এই পদ্মাবতী রসে রস রস কথা হিন্দুস্থানী ভাষে সেখে রচিয়াছে পোথা।।/ রোসাঙ্গির আন লোক না বুঝে এ ভাষ।’ আলাওল পুর্তগীজ জলদসুদের হাতে বন্দী হয়ে চট্টগ্রাম আসেন। কবি মাগন ঠাকুর তখন তাঁকে সহায়তা করেন। তিনি মাগন ঠাকুরের আদেশে নানাবিধ ছন্দে পুঁথি রচনা করেন। তারপর থেকে তিনি চট্টগ্রামের হাটাহাজারী স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। ফতেয়াবাদে আলাওলের দিঘী এখনও সর্বজন পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হলো–হপ্ত পয়কর, তোহফা, সয়ফুলমুলক, সিকান্দর নামা।
আলাওলের মতো যমুনা তীরবাসী মাধবাচার্য্য পশ্চিমা কবি হলেও চট্টগ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তাঁর বংশধররা চক্রশালায় আছেন। মাধবানন্দ ১৫০১ শকে জাগরণ পুঁথি লিখেছিলেন। এটি এখনও এ জনপদে পঠিত হয়। কবি মাগন ঠাকুরের বাড়ি আনোয়ারা। মাগন ঠাকুর আরাকানরাজ শ্রীধর্মের কন্যার সমবয়সী ছিলেন। একারণে রাজার আনুকূল্য পেয়েছিলেন। তিনি মাগন বা কোরেশী মাগন নামে পরিচিত ছিলেন। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। চন্দ্রাবতী তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
আলাওলের মতো কবি পরাগল খাঁ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের নানান মত আছে। প্রকৃত সত্য এখনও অনুটঘাটিত আছে। পরাগল খাঁকে লোক সাহিত্যিক দীনেশ চন্দ্র সেন মুসলিম হিসেবে উল্লেখ করে পিতার নাম রস্তিখাঁ লিখেছেন। কিন্তু কোন প্রামাণ্য ভিত্তি নেই। পরাগলী মহাভারতে আছে, কবি পরাগল খাঁ ক্ষত্রিয় সেনাপতি ছিলেন। তিনি রুদ্রবংশীয় হিন্দু সন্তান ছিলেন। পরাগল খাঁ নিয়মিত মহাভারত পাঠ করতেন। তখন মুসলমানদের জন্য মহাভারত পাঠ বা শ্রবণ নিষেধ ছিল। তাঁর বাড়ি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উত্তর–পূর্বদিকে কোথাও হবে।
চট্টগ্রামে জন্মেছেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একমাত্র ও প্রথম মুসলিম নারী কবি রহিমুন্নিচা। তিনি নামের আগে শ্রীমতি ব্যবহার করতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীর মাতা ফাতেমা খাতুন চৌধুরাণী ছিলেন কবির পৌত্রী। তাঁর সময়কাল নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে তাঁর সমাধিতে লেখা আছে জন্ম ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ। হাটাহাজারীর মেখলে শ্বশুরালয়ে সমাহিত করা হয়েছে। পুন্ডরীক বিদ্রানিধি’র বাড়ি হাটাহাজারির মেখল।
পরাগল খাঁ’র সমকালীন লেখক হলেন শ্রীকর নন্দী। তাঁর বাড়ি আনোয়ারা। তিনি অশ্বমেধ পর্ব রচনা করেছিলেন। মুকুন্দ দত্ত জন্মেছিলেন ছনরা। চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি আরও যেসব প্রাচীন কবি ও বৈষ্ণব পদাবলি লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁরা হলেন– কৃষ্ণরাম দত্ত, বাণীরাম ধর, ভগীরথ, রতিরাম দাস, লক্ষীনারায়ণ, দ্বিজ রামতনু, মুক্তারাম, রঙ্গাই, জগদীশ সিংহ, মুক্তারাম দাস, রামজীবন রুদ্র, নীলকমল দাস, রতিতেব ভট্টাচার্য্য, রঘুনাথ, যদুনাথ, অভিরাম, দ্বিজ রামজীবন, হেমন্তবালা দত্ত, শৈলজা সুন্দরী. পীর মাহা, মির্জাকাঙালি, নাছির উদ্দিন, আলী রাজা প্রমুখের কারণে চট্টগ্রাম বাংলা সাহিত্য চর্চ্চায় বঙ্গদেশকে মধ্যযুগের অন্ধকারে আলোর পথ দেখিয়েছিল।
পরবর্তীকালে সে আলোকে আরও বিস্তৃত করেছিলেন মহাকবি নবীন সেন, রায় শরচ্চন্দ্র দাস বাহাদুর, গোবিন্দদাস চৌধুরী, জগচ্চন্দ্র দাস, উমাচরণ মুখার্জী, গৌরচন্দ্র কুন্ড, নবরাজ বড়ুয়া, সর্বানন্দ বড়ুয়া মোক্তার, শরচ্চন্দ্র দাস, হরগোবিন্দ মুচ্চদি, বজ্র কুমার সেন, দ্বারিকানাত সেন, প্রসন্ন কুমার কর্মকার, কালীকুমার শর্মা, ধর্মরাজ বড়ুয়া, কালীনাথ সেন, বিজয়রাম, গোস্বামী জগচ্চন্দ্র, ষষ্টিচরণ মজুমদার, অন্নদাচরণ খাস্তগির, হরিদাস, জগদ্বন্ধু চৌধুরী, রামকিনু দত্ত, নলিনীরঞ্জন সেন, চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী, নীলমণি দস্তিদার, যাত্রামোহন দাস, নবীন চন্দ্র দাস, শ্যামাচরণ খাস্তগির, ত্রিপুরা চরণ রায়, ভোলানাথ মুন্সী, জগদ্বন্ধু চৌধুরী, উমাকান্ত ভট্টাচার্য্য, জগচ্চন্দ্র শর্মা, দুর্গা পাঠক, গোবিন্দ চক্রবর্তী, গোবিন্দদাস চৌধুরী, লক্ষীচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, জগচ্চন্দ্র দাস, মাইকেলের জীবনীকার কবিভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেন, আবুল ফজল, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, রমেশ শীল প্রমুখ। রূপকথার চরিত্রের মতো এই প্রিয়মুখগুলোর কারণে চট্টগ্রামের শিল্প–সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁরা আমাদের পথিকৃত।
তথ্যসূত্র : চৌধূরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি: চট্টগ্রামের ইতিহাস, গোলাম কুদ্দুছ : ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।