সমপ্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী ‘ল্যানসেট’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে এই ক্যানসার নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ নারীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে এই স্তন ক্যানসার। ল্যানসেটের ওই গবেষণায় বলা হয়, ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে সারা বিশ্বে প্রায় ৭৮ লাখ নারীর স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন ৬ লাখ ৮৫ হাজারের মতো নারী।
ল্যানসেট কমিশনের অনুমান, বিশ্বজুড়ে ২০২০ সালে স্তন ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ এবং এই সংখ্যা ২০৪০ সালের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়ে বছরে ৩০ লাখের বেশি হতে পারে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এটির প্রভাব পড়ছে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। অর্থাৎ এসব দেশে রোগটির প্রভাব প্রকট।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০৪০ সালের মধ্যে এ রোগে বছরে মৃত্যু হবে ১০ লাখ মানুষের। ‘ব্যাপক বৈষম্য’জনিত প্রভাবের পাশাপাশি স্তন ক্যানসারের উপসর্গজনিত দুর্দশা, হতাশা ও অর্থনৈতিক বোঝা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এসব সমস্যা প্রায়ই গোপন থাকছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের রেশমা জাগসি বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে নারীর মৌলিক মানবাধিকার সব দিক থেকেই পুরুষের চেয়ে কম গুরুত্ব পায়।’ ওই গবেষণাপত্রে বেশ কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে রোগী ও স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে আরও ভালো যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ভুগতে থাকা রোগীর জীবনযাত্রার মান, শারীরিক অবস্থা, ক্যানসার চিকিৎসার থেরাপির কার্যকারিতা ও ইতিবাচকভাবে বেঁচে থাকার মতো ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরমান রেজা চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, গত এক দশকে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় এবং চিকিৎসায় বাংলাদেশে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বর্তমানে এই রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার প্রায় শতভাগ বাংলাদেশেই বিদ্যমান। তিনি বলেন, একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে শতভাগ স্তন ক্যান্সার রোগীকে এফএনএসি, অর্থাৎ টিউমার থেকে রস নিয়ে সেটি পরীক্ষা করে ক্যান্সার প্রমাণিত হলে তার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হতো। ক্যান্সারের চিকিৎসার বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টি মোটেই স্ট্যান্ডার্ড নয়।
স্তন ক্যান্সারসহ যে কোনো ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রথমত বায়োপসি করে এতে যদি ক্যান্সার প্রমাণিত হয়, তবেই চিকিৎসা করা উচিত। স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে শুরুতেই বায়োপসি করে নিতে পারলে অনেক সুবিধা রয়েছে। যেমন–শুধু বায়োপসির ফলাফলের ভিত্তিতে নয়, এখন কিন্তু স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরুর আগে কিছু হরমোন রিসেপটর পরীক্ষা করতে হয় এবং সেগুলোর ওপর নির্ভর করে কীভাবে চিকিৎসা শুরু হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ এ রোগীর প্রথমেই অপারেশন করতে হবে, নাকি কেমোথেরাপির চিকিৎসা অথবা কেমো–ইমিউনোথেরাপির চিকিৎসা দিতে হবে– সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। প্রায়ই আমরা ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা কথা শুনে থাকি, ক্যান্সারটি কোন স্টেজে অথবা কোন পর্যায়ে রয়েছে। স্টেজিং জানতে গেলে বেশ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পেট স্ক্যান, বোন স্ক্যানসহ আরও কিছু পরীক্ষা রয়েছে। পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে ক্যান্সারের পর্যায় নির্ধারণ করতে হবে এবং অবশ্যই সেটা চিকিৎসা শুরুর আগে।
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ মনে করত স্তন ক্যান্সার হলে সম্পূর্ণ স্তনটি কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট কনজারভেটিভ সার্জারি, অর্থাৎ স্তনটি রেখে টিউমার অপসারণ করার মাধ্যমে যে সার্জারি করা হয়, সেটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
একটা সময় ছিল, স্তন ক্যান্সারে রেডিওথেরাপির চিকিৎসা দিতে গেলে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ত। বর্তমানে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও তিন সপ্তাহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক সপ্তাহেই স্তন ক্যান্সারের রেডিওথেরাপির চিকিৎসা সম্পন্ন করা সম্ভব।
সাধারণ মানুষের মধ্যে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। উপসর্গ দেখা দিলেও সংকোচবোধের কারণে নারীরা দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যান। ফলে তিন–চতুর্থাংশ রোগীর রোগ ধরা পড়ে রোগের শেষ পর্যায়ে। অথচ শুরুতে শনাক্ত হলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরিবারের নারী সদস্যকে স্তন ক্যানসারের মৃত্যুঝুঁকি থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পুরুষদেরও সচেতন হতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে ক্যানসার চিকিৎসা। বিশ্বে ক্যানসারের এত আধুনিক চিকিৎসা বেরিয়েছে যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এখন মারা যাওয়াই কঠিন। অথচ আমাদের দেশে আধুনিক অনেক চিকিৎসাব্যবস্থাই অনুপস্থিত। এরপরও স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে উপসর্গ শুরু হওয়ার আগে ক্যানসার শনাক্ত করা গেলে মৃত্যুঝুঁকি কমে আসবে।
তাঁরা বলেন, জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের সঙ্গে স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং যুক্ত করে পাঁচ শতাধিক সরকারি হাসপাতালে সেবা দেওয়া হয়। তবে এই সেবাব্যবস্থা অসংগঠিত ও অসম্পূর্ণ। স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার–এই তিনটির জন্য সমন্বিত জাতীয় স্ক্রিনিং কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার।