বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার পীঠস্থান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আদ্যাক্ষরে “বুয়েট” (BUET) নামে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানটি কয়েকদিন ধরে জাতীয় রাজনীতির এক আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত আবরার নামে এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন থেকে ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ রয়েছে। এর আগে ২০০২ সালে ছাত্র দলের দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষের মাঝে পড়ে নিহত হয় সানি নামের এক বুয়েট শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় সম্প্রতি এক গভীর রাতে ছাত্রলীগ নেতারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। প্রতিবাদকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ও একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর স্থায়ী বহিস্কার দাবী করে।
গত চার বছর বুয়েট ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ থাকলেও দেশের চলমান রাজনীতি, সামাজিক সংকট, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব থেকে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই ব্যাক্তিগত জীবনে, মনে মননে, চিন্তায়–কর্মে বিচিছন্ন ছিলনা। আবরারের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারের রায় ঘোষিত হবার পরেও হত্যাকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের ক্ষোভ ও রাজনীতি শূন্য পরিবেশে ধর্মীয় আচার–আচরণের আপাত নির্দোষ কর্মকান্ডের আড়ালে কিছু সংগঠন যে সক্রিয় ছিল তাদের রাজনীতিতে, তথা ভাবাদর্শিকভাবে ছাত্রদের সংগঠিত করার কাজে তা এরি মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বিরাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাবিহীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যে ধর্মান্ধতার উর্বর প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয় তার প্রমাণ আমাদের দেশে প্রচুর রয়েছে। বুয়েট সংলগ্ন ঢাকা সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলন চলবে পাশাপাশি বুয়েটে বছরের পর বছর তা বন্ধ থাকবে তা তো মানা যায় না। ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ২০০২ সালে সানি হত্যার পর তো রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি। নিষিদ্ধ করতে হবে ছাত্র রাজনীতির নামে প্রত্যেক সরকারের আমলে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের দখলবাজি, দূর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি। ছাত্র আন্দোলনের স্বাধীন ও সুস্থ ধারাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য, সব সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য, ক্যাম্পাসে শিক্ষার পাশাপাশি অতীতের মত সাংস্কৃতিক তৎপরতা চালু করার দাবিতে ছাত্রদের সাধারণ ঐক্যই অর্গল মুক্তির পথ। এই ঐক্যের দাবী কখনো ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করার জন্য হতেই পারেনা। এই সময়ে কোন দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক চর্চাও ক্যাম্পাসে নিশ্চয়ই হয়নি। সংস্কৃতিবিহীন শিক্ষা তো এক ধরনের একাডেমিক অন্ধত্ব। তা ইহজাগতিক জীবনভাবনার বিপরীতে শিক্ষার্থীদের সহজেই অন্ধ বিশ্বাসের অযৌক্তিক পথে নিয়ে যায়। সেই যুক্তিহীনতার অন্ধ পরিবেশে নির্বিঘ্নে, নিজেদের মত করে যাদের রাজনীতি করার কথা তারা ঠিকই এই চার বছর তা করে গেছে। জিয়া এরশাদের আমলে তৎকালীন ইউকসু বা বুয়েট ছাত্র সংসদের পরপর তিনবার নির্বাচিত ভিপি, ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি, প্রয়াত খন্দকার ফারুককে তো ক্যাম্পাসে সব সংগঠনের নেতা এমনকি কর্মচারীরা পর্যন্ত আন্তরিক ভাবে শ্রদ্ধা করত সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণে তাঁর নিবেদিত কর্মকান্ড, নিরহংকার ও পক্ষপাতহীন মার্জিত আচরণের জন্য। তাঁর সময় বুয়েট ক্যাম্পাসে যর্থাথই শিক্ষা ও উন্নত সংস্কৃতি চর্চা, নির্বাচন ও ছাত্র আন্দোলনের এক অনন্য নজির স্থাপিত হয়েছিল। দেশ–বিদেশের সাবেক বুয়েটিয়ানদের নিশ্চয়ই তা স্মরণে আছে। তাহলে এখন ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? তখন অবশ্য বুয়েটের ছাত্রদের দেশের মানুষের টাকায় পড়ালেখা করে আজকের মত বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা ছিলনা। এখন এসব আত্মকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের মনে ও মননে দেশ ও জনগণের ভাবনা অনুপস্থিত। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এদের লক্ষ্য হল ইহলোকিক সুখ ও সম্প্রতি সমাজ মানসের প্রতিফলনে গড়ে উঠা পারলৌকিক মুক্তির ভাবনা। ফলে এই আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে এরা ছাত্র আন্দোলন ও সংগঠন বিরোধী হয়ে উঠেছে। প্রগতিশীল সুস্থ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দায়িত্ব হলো এই সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার বিপরীতে এদের মানবিক করে তোলা।
এরশাদ পরবর্তী সময়ে ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী ধারা কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর দলীয় ছাত্র রাজনীতির অপতৎপরতায় কলংকিত হয়েছে বার বার। সব সরকারের সময়ে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের দাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো সাধারণ ছাত্র এবং বিরোধী রাজনীতির সমর্থক ও বাম প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের কাছে আতংক ও নির্যাতনের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছে। দুই বৃহৎ দলের লেজুড় ছাত্র সংগঠন ছাড়াও এরশাদের সময় থেকে চর দখলের মত চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রতিষ্ঠিত কিছু কলেজ বলতে গেলে ধর্মান্ধ একটি ছাত্র সংর্গঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিল টানা প্রায় ২০/২৫ বছর ধরে। অবরুদ্ধ অবস্থায় অব্যাহত ভাবে সেখানে চলেছে খুন–নির্যাতন। বলতে গেলে গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনটি প্রধান ছাত্র সংগঠনের দ্বারা ছাত্র আন্দোলন কলুষিত হয়েছে অনৈতিক জবরদস্তিতে, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা জাঁকিয়ে বসেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, অগনতান্ত্রিক স্বজনপ্রীতি, দলাদলি ও সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছে উচ্চ শিক্ষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ছাত্র রাজনীতির নামে এই উৎকট বিরাজনীতিকরণের ধারা এখনো অব্যাহত।
এ সময়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয় বিবেচনা, ব্যক্তিগত সর্ম্পক ইত্যাদি কারণে দীঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান দ্রুত কমতে থাকে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের যে উদার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী থাকা প্রয়োজন দুঃখজনক ভাবে তা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সামগ্রিকভাবে আজ অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যার সংগ্রহশালা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ ধর্ম, সম্প্রদায়, সংকীর্ণ রাজনীতিতে কোটরাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। নিরন্তর জিজ্ঞাসাই হলো শিক্ষার মর্মবস্তু। এর বিপরীতে বিজ্ঞানের শিক্ষক জীবন ও জগতের তথা বস্তুবিশ্বের সতত পরিবর্তন ও বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের পাঠদান করে চলেছেন। এ হলো এক ধরনের একাডেমিক অনৈতিকতা। হ্যামলেট যখন সর্বজনীন মানবিক চরিত্র নিয়ে বলে উঠে “What a piece of work is man ! How noble in reason! How infinite in Faculties” তখন মানুষের অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে সাহিত্যের শিক্ষক মানবকেন্দ্রিক রেনেঁসা ভাবনার বদলে সহস্রাব্দ প্রাচীন অদৃশ্য বিশ্বাসের সাম্প্রতিক জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিলে reasonও র infinite in Faculties এ ঋদ্ধ মানুষের অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাসী শেকসপীয়রের পাঠ দান করবেন কেমন করে বোধগম্য নয়। কাজেই শাসক গোষ্ঠীর অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র আন্দোলন নিয়ন্ত্রনণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জবর দখল, সাংস্কৃতিক ভাবনা চিন্তার মুক্ত প্রবাহ রুদ্ধ করে দেয়া, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল ছাত্রদের কর্মকান্ড দমন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে ভাবাদর্শিক শূন্যতার সৃষ্টি করা হয়েছে সে শূন্যতা ইতোমধ্যে পূরণ করে ফেলেছে বলা যায় ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলতার আপাত শক্তিশালী ভাবাদর্শ। তার প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সীমিত নেই, ছড়িয়ে পড়েছে দর্শনের দারিদ্র্যে উদ্ভ্রান্ত পথ হারা তারুণ্যের মাঝে ও জনজীবনে। তাই দেখি হলি আর্টিজানের নির্মম হত্যকান্ডে জীবন বাজি রেখে অংশ নেয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানেরা অর্থাৎ পুরো সমাজ মানস বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত আমলা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক মায় শিক্ষিত অভিভাবকরাও আজ সংখ্যাধিক্যের ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাত সম্প্রদায়গত ঘৃণা, বিভেদ আর বিদ্বেষের হলাহলে আকীর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম অবাধে চললে আখেরে লাভবান হয় গণতন্ত্র, মুক্ত বিশ্বাস ও উদার ভাবধারায় বিশ্বাসী শক্তি, ঋদ্ধ হয় উন্নত মানবিক সাংস্কৃতিক আবহ। সাধারণ ছাত্ররা তখন নির্বিঘে,্ন নিরাপদে, জ্ঞানে–কর্মে–সৃজনশীলতায় ব্যাপৃত থাকতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় শিক্ষকরাও মুক্ত চিন্তার চর্চা ও জ্ঞান সৃজনে উদ্যোগী হয়ে ওঠে।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের দল তৈরি করে, মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করে দিতে পঞ্চম বাহিনী হিসাবে সমস্ত সহায়তা দিয়ে ধর্মান্ধ শক্তিকে মাঠে নামান এবং ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধের ভাবাদর্শিক প্রচার ও প্রতিক্রিয়াকে জন মানসে প্রোথিত করার সর্ববিধ উপায় গ্রহণ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নামে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধের অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে অতি সহজেই একটি শক্তিশালী ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী বিকল্প শক্তি গড়ে ওঠে অথচ এই স্বাধীনতা সব ধর্মের মানুষের মিলিত ত্যাগ ও রক্তের ফসল। আবরার হত্যাকান্ডসহ নির্যাতনের নানা ঘটনায় বুয়েটের সাধারণ ছাত্রদের নানাবেশী ধর্মান্ধরা মাঠে নামিয়ে ছাত্রলীগকে যেমন কোণঠাসা করে দিয়েছে ঠিক তেমনি সিন্ডিকেটবাজি, লুটপাট, ব্যাপক দুর্নীতিসহ শাসক দলের অপকর্মের ধারায় সৃষ্ঠ গণঅসন্তোষকে প্রগতিশীল বিকল্পের দৃৃশ্যমান অনুপস্থিতিতে সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে এক ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াশীল গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে দ্রুত এগিয়ে চলেছে নানাভাবে। সাম্প্রদায়িকভাবে বিদ্বিষ্ট, অদৃষ্টবাদে সমর্পিত, ক্ষুব্ধ সমাজ মানস আজ ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে মানবতা বিরোধী ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়ার নীতিকথায় প্রলুব্ধ হয়ে বিপজ্জনক পথে এগিয়ে চলেছে। সব মিলিয়ে সমাজে বিষয়গত অবস্থান এদের জন্য প্রস্তুত। তাই বলছিলাম বুয়েটের ঘটনা ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভয়ংকর ও আতংকিত পূর্বগামী প্রতিচ্ছায়া।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট