কয়েকদিন আগে লন্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশী বাংলাদেশ বিমানে করে দেশে আসার জন্য অনলাইনে টিকিট কাটতে চাইলে সব টিকেট সেল, এমনটা দেখতে পান। কয়েকদিন অপেক্ষার পর তিনি আবার ট্রাই করলে বিমানের একটি টিকিট পান। যাত্রা করে তিনি দেখতে পান বিমানে অধিকাংশ সীট খালি। বিষয়টি তিনি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেন ও প্রশ্ন করেন দুই তৃতীয়াংশ সীট খালি থাকার পরও কেন বিমানের অনলাইনে সব সীট সেল দেখালো? শুধু তিনি নন, যারা বিদেশ ভ্রমণ করেন তাদের অনেকের অভিজ্ঞতাই এমন। কিন্তু এটি কি কোনো কারিগরি ত্রুটি, নাকি অন্য কোনো বিষয় এতে লুকিয়ে আছে সেটি বোধগম্য নয়।
শুধু টিকিট বিক্রি নয়, বিমানের অন্যান্য সার্ভিস নিয়েও যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। কেবিন ক্রুদের খারাপ আচরণ, ফ্লাইট শিডিউল ঠিক না থাকা, খাবারের নিম্নমান, সোনা চোরাচালান, লাগেজ লেফট বিহাইন্ড হওয়া–ইত্যাদি অভিযোগ চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এর বাইরে বিভিন্ন চুক্তি, বিমান লীজ, বিভিন্ন ক্রয়, বিক্রয় ও অদক্ষতার সংবাদ প্রায় প্রকাশিত হয়।
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র একটি ডিসি–৩ উড়োজাহাজ নিয়ে বিমানের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হলেও বিমানের বহর এখন বেশ সমৃদ্ধ। এখন সংস্থাটিতে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এরমধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭–৩০০ ইআর, ৪টি বোয়িং ৭৮৭–৮, ২টি বোয়িং ৭৮৭–৯, ৬টি বোয়িং ৭৩৭–৮০০ এবং ৫টি ডি হ্যাভিল্যান্ড কানাডা ডিএইচসি–৮ কিউ৪০০। এতো সমৃদ্ধ বিমান থাকার পরও বিমান প্রায় প্রতিবছর লোকসান দেয়। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিমানের দেনার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া নতুন উড়োজাহাজের জন্য বছরে ২৫০ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
এদিকে ২০২৩ সালে সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় দেখা যায়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকিট কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সেবা ক্রয়ে ‘জালিয়াতিপূর্ণ‘ চুক্তির কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় এই গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়ে। বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিমান ২০২০–২১ (২০২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত) অর্থবছরে ১৩৩ কোটি টাকা লাভ ও ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৮১ কোটি ১৩ লাখ টাকা লোকসান করে। উক্ত স্বার্থবিরোধী চুক্তিতে ১০ বছরে বিমানের লোকসান হবে কমপক্ষে ১,০৫৯ কোটি টাকা। দরপত্র মূল্যায়নে নিয়ম ভঙ্গ ও তথ্য গোপন করে চুক্তি করায় এই লোকসান হবে বলে বাংলাদেশের মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি ও বুকিং সেবার জন্য জিএলবিএল ইনকর্পোরেটেডের সঙ্গে বিমান চুক্তি করেছে। ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই সেবা নিয়েছিলো বিমান। সে সময়ে ‘এসআইটিএ‘ নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিমানকে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) সেবা দিচ্ছিল যা টিকিট বুকিংয়ের পর কতজন যাত্রী উড়োজাহাজে উঠছে, তার হিসাব রাখে। এ ছাড়া, তারা প্রি–ফ্লাইট অপারেশনের একটি টুল ডিপারচার কন্ট্রোল সিস্টেমও (ডিসিএস) দিয়ে আসছিলো।
২০১৯ সালের অক্টোবরে এসআইটিএ বিমানকে জানায়, তারা আর পিএসএস ও ডিসিএস পরিষেবা দেবে না। ২০২০ সালের ৩ জুন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পিএসএস, ডিসিএস, ই–কমার্স, লয়্যালটি প্রোগ্রাম, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স, গ্রাহক পরিষেবার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় জিএলবিএলের সঙ্গে চুক্তি করে বিমান। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতায় টেক্সাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো তাদের আর্থিক প্রস্তাবের বিস্তারিত তথ্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সামনে উপস্থাপন না করা। বিমানের কর্মকর্তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই কাজটি করেছেন। এই চুক্তি হলে ১০ বছরে অন্তত ১,০৫৯ কোটি টাকার লোকসান হতে পারে,এই প্রাক্কলিত তথ্যও গোপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে পিএসএস ও ডিসিএস ব্যবহারের খরচ প্রতি বছর ২% করে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়নের সময় এই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। পরে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এ ছাড়া চুক্তিতে এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি।
চুক্তি অনুযায়ী, ‘এসআইটিএ‘র সিস্টেম থেকে ‘সাবের‘র সিস্টেমে ডেটা স্থানান্তরে ৫ দিন বেশি সময় লাগায় এবং ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও লয়্যালটি প্রোগ্রাম সম্পর্কিত কিছু কাজ বাকি থাকায় প্রতিষ্ঠানটি বিমানের কাছে ৪০ হাজার ডলার পাওনা দাবি করেছে। চুক্তির যে ধারা অনুযায়ী এই অর্থ দাবি করার সুযোগ পেয়েছে, তা নিয়েও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মাত্র ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। অথচ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, অন্তত ৪ জন দরদাতাকে অংশ নিতে হবে।
অন্য এক প্রতিবেদনে সৌদি আরবে অনিয়মের কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিপুল পরিমাণ জরিমানার খবর জানা যায়। নির্ধারিত সময়ে বিমানের উড়োজাহাজ অবতরণ ও উড্ডয়ন না করা, খাবার ও হোটেলের অব্যবস্থাপনা, টানাহেঁচড়ায় যাত্রী হয়রানি এবং কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি না মানার গুরুতর অভিযোগের কথা। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম হয়েছে বিমানের জেদ্দা স্টেশনে। আগের অর্থবছরের অডিটে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। অডিটের তথ্য অনুযায়ী, মহামারী কালে ২০১৯ সালের কয়েকটি এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিমানের মোট ৯টি ফ্লাইটে জীবাণুনাশক না ছিটানোয় সৌদি আরবের ডিরেক্টর অব হেলথ কন্ট্রোল এবং জেনারেল অথরিটি অব সিভিল অ্যাভিয়েশন বিমানকে জরিমানা করে। ফ্লাইট প্রতি ৫০ হাজার হিসেবে মোট জরিমানার পরিমাণ ৪ লাখ ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ কোটি ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। সৌদি আরব বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বিমানের আয়ের এক–তৃতীয়াংশ আসে এই দেশ থেকে। হজ্ব ও ওমরাহর বাইরে বোয়িং ৭৭৭–৩০০ ইআর মডেলের একটি উড়োজাহাজ প্রতিদিন জেদ্দায় যাওয়া আসা করে। অডিটের তথ্য অনুযায়ী, বন্দর ছাড়তে বিলম্বের কারণে বিমানকে অতিরিক্ত পার্কিং মাশুল গুনতে হয়েছে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া ঐ অর্থবছরে বিমান ১১৯ জন অবৈধ যাত্রী বহন করে। এজন্য বিমানের ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর জেনারেল সেলস এজেন্টের (জিএসএ) প্রদেয় টেলিফোন বিল বিমান পরিশোধ করায় ক্ষতি হয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এদিকে জরিমানার টাকা পরিশোধ না করলে উড়োজাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে পারে চিন্তা করে বিমান এ পর্যন্ত দেড় লাখ সৌদি রিয়াল পরিশোধ করেছে। তবে এই জরিমানার ফলে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বিদেশে বিমানের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
বিমানের অদূরদর্শিতা এবং লোকসানের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা। বেশ কয়েক বছর আগে মিসর থেকে দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনে সাত বছরে আয় হয়েছিল ২৩২৯ কোটি টাকা। আর এগুলোর পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩৪৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সাত বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিমান।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমান কার্যক্রম শুরুর কয়েক বছর পর কার্যক্রম শুরু করে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস। তারও এক যুগ পরে কার্যক্রম শুরু করে ইমেরেটস এয়ারলাইনস। এখন এই দুইটি এয়ারলাইনস বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশের নামকরা সব এয়ারলাইনসের সাথে পাল্লা দিয়ে বিপুল সুনাম কুড়াচ্ছে ও কোটি কোটি ডলার মুনাফা করছে। অন্যদিকে আমরা বছর বছর লোকসান দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করছি।
প্রশ্ন হলো শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিটির অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর লোকসান জরিমানার দায় কি বিমান পরিচালনাকারীরা এড়াতে পারেন? অথবা মন্ত্রণালয়ও কি এর দায় এড়াতে পারে?
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিভিন্ন সময় বিমানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হলেও কারা এর জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করা হয় না বা শাস্তির আওতায়ও আনা হয় না। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কৈফিয়ত না থাকায় অনিয়মকারীরা আরো বেশি অনিয়ম করতে উৎসাহিত হয়। তাই সময় এসেছে বিমানকে লোকসানের দুষ্টু চক্র হতে বের করে আনার। কারণ অর্ধ যুগ একটি সংস্থার দক্ষতা অর্জনের জন্য কম সময় নয়। তাই প্রয়োজন বোধে বিমানের পরিচালনার দায়িত্ব দেশি–বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে হলেও একে স্বাবলম্বী ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মত সংস্থায় পরিনত করতে হবে। না হয় যুগ যুগ ধরে লোকসানে চলবে আমাদের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।