বান্দরবানে সশস্ত্র সংগঠন কুকি–চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক চেওচিম বমকে (৫৪) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে ২টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বান্দরবানে ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে শতাধিক সশস্ত্র সদস্য নিয়ে তিনটি ব্যাংকের শাখায় হামলা, অর্থ এবং অস্ত্র লুট ও অপহরণের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
র্যাব জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার গভীর রাতে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের শ্যারন পাড়ার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নাম চেওচিম বম। তিনি পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক। এ সময় তার বাসার আলমারি থেকে ২টি অস্ত্র এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাব ১৫ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর র্যাব–১৫ বান্দরবান অফিসে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কেএনএফের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি কেএনএফের সশস্ত্র শাখার লোকজনদের বাড়িতে রেখে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ এবং সহযোগিতা করে আসছিল।
তিনি বলেন, চেওচিম বমকে তার বাড়ির একটা লোহার লকারে পাওয়া গেছে। তিনি সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। সেটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। তালা ভেঙে তাকে বের করা হয়। শ্যারন পাড়া সুয়ালক ইউনিয়নে পড়লেও এর অবস্থান মূলত বান্দরবান–চিম্বুক সড়কের পাশে; যার দূরত্ব জেলা সদর থেকে প্রায় ৮–৯ কিলোমিটার।
জানা গেছে, যৌথবাহিনী রুমা ও থানচিতে তাণ্ডবের ঘটনায় ৬ জনকে আটক করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৫ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও আলীকদম উপজেলার সীমান্ত এলাকাগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। রোয়াংছড়ি–রুমা সীমান্তের পাইক্ষ্যংপাড়া, খেপলঙ পাড়া, রনিন পাড়া এলাকায় কেএনএফের সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
আরো দুটি মামলা : কেএনএফের ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র ও অর্থ লুটের ঘটনায় আরও ২টি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮টিকে। এর মধ্যে রুমায় ৪টি এবং থানচিতে ৪টি মামলা হয়েছে। সবগুলো মামলার আসামি অজ্ঞাত।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, রুমার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১টি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা, ১টি মসজিদের ইমাম, ১টি পুলিশ ও ১টি আনসার বাদী হয়ে করেছে। থানচিতে ১টি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা, ১টি কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা এবং দুটি পুলিশ বাদী হয়ে করেছে। মামলায় বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
আতঙ্ক কাটেনি : কেএনএফের তাণ্ডবের ঘটনায় রুমা এবং থানচিতে গতকালও থমথমে অবস্থা ছিল। দুই উপজেলার মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, কেএনএফ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রুমা ও থানচি উপজেলার ব্যবসায়ীদের মাঝেও। ঈদকে সামনে রেখে পর্যটকদের বরণে নেওয়া প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়েছে। দোকানপাট ঠিকমতো খুলছে না। যারা খুলছেন তারাও সন্ধ্যার আগে গুটিয়ে নেন। স্থানীয় বাজারগুলোতে লোকজনের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। পাহাড়ের অনেক গ্রামের লোকজন অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে।
বান্দরবান হোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের ভ্রমণে কোনো বাধা নেই। কিন্তু কেএনএফের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে ভ্রমণকারীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকে ঈদের বুকিং বাতিল করেছে। তবে আমরা পর্যটকদের আশ্বস্ত করতে চাই, নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক, মেঘলা, শৈলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, বৌদ্ধ ট্যাম্পলসহ আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণে নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই।
শান্তি কমিটির বিবৃতি : কেএনএফের সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। গতকাল রোববার বিকালে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কাঞ্চন জয় তঞ্চঙ্গ্যা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, কেএনএফের দাবি অনুযায়ী বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সমন্বয়ে এ পর্যন্ত রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার ৯৬৮টি বম পরিবারের মাঝে ১৩৪ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য, নগদ অর্থ, শীতবস্ত্র, চিকিৎসা সহায়তা প্রদানসহ তাদের কারান্তরীণ ২ জন সদস্যকে জামিনে মুক্তি লাভে সহায়তা করা হয়। অবশিষ্ট কারান্তরীণ সদস্যদের মুক্তির ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত বম জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য এলাকায় খাদ্যশস্য পৌঁছানো হয়েছে। তাদের উত্থাপিত দাবিসমূহ ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট গোচরীভূত করা হয়েছে। তারপরও কেএনএফ সদস্যরা গত ২ এপ্রিল রুমা উপজেলায় অতর্কিতভাবে সশস্ত্র অবস্থায় বর্বরোচিত হামলা, সরকারি কর্মকর্তা ও পথচারীদের জিম্মি করে হামলা, অর্থ লুটের উদ্দেশে সোনালী ব্যাংকে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র লুট করে নেওয়া এবং ৩ এপ্রিল থানচি উপজেলায় স্থানীয়বাসীদের জিম্মি করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ ও দুটি ব্যাংক লুট করার মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে সমগ্র জাতি স্তম্ভিত ও মর্মাহত হয়েছে। সমঝোতা চুক্তির শর্তাবলী লক্সঘন করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অপহরণের শিকার ব্যাংক কর্মকর্তা নেজাম উদ্দিনকে ৪ এপ্রিল উদ্ধার করা গেলেও পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও এলাকার শান্তি শৃক্সখলা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটিসহ আপামর জনগণ এই পরিস্থিতি কামনা করছে না। এমন অশান্ত পরিস্থিতি পরিহার এবং সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী কেএনএফের সকল সদস্যকে শান্তি বজায় রাখতে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কেএনএফ নামে এই সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের শুরুর দিকে। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে এ সংগঠন গঠন করার কথা বলা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু লোক রয়েছে। সে কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়। কেএনএফ বলছে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি–চিন রাজ্য’ গঠন করতে চায় তারা।