মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরিশুদ্ধ, পবিত্র এবং পাপমুক্ত করার কিছু দিনক্ষণ ও শুভ সময়, মুহূর্ত স্থির করে দিয়েছেন। পাপে তাপে অবক্ষয়ে নিমজ্জিত বান্দাদের পাপরাশির ভার হাল্কা করতেই মাহে রমজানে মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর উপহার দিয়ে অপরিসীম করুণাধারায় সিক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা ও মুক্তিদাতা মহান আল্লাহ্র রহমত ও করুণার বিশাল সিন্ধুতে ডুব দিয়ে পাপাচারে অভ্যস্ত মানুষ যাতে কৃত অপরাধের কারণে অনুশোচনার সুযোগ পায় সেজন্যই মুক্তির উপলক্ষ হিসেবে আমাদের মধ্যে লাইলাতুল কদর দান করেছেন মহান প্রভু। পৃথিবীতে নানা কারণে, অসৎসঙ্গ তাড়িত হয়ে, খেয়ালের ভুলে কিংবা স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মানুষ খোদার বিধান অমান্য করে পাপাচারে জড়িয়ে পড়ে। স্খলন ও ভুল মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
আল্লাহ্র বিধিবিধান সঠিকভাবে পালনে অনেকেই অভ্যস্ত হতে পারে না। ফলে ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় মানুষ নানাভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। এভাবে বছর বছর ভুল ও অপরাধ প্রবণতার মাত্রা বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে মানুষ চরম পাপসাগরে হাবুডুবু খায়। আল্লাহ্র ক্রোধ ও শাস্তির ভয়ে তখন সে বিচলিত, হতাশাগ্রস্ত ও নিরাশ হয়ে পড়ে। এ ধরনের বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা জেনে বা না জেনে নিজেদের ওপর জুলুম করে গ্ল্লানি থেকে বাঁচতে চায় তাদের জন্য লাইলাতুল কদর এক বিরাট সুযোগের হাতছানি। আল্লাহ্ পাক অপরাধবোধে ভীত ও অনুশোচনাকারী বান্দাদের আশ্বস্ত করে পবিত্র কুরআনে অভয়বাণী দিচ্ছেন– ‘হে বান্দারা তোমরা আল্লাহ্র অনুগ্রহের ব্যাপারে নিরাশ হয়ো না।’ যারা কায়মনোবাক্যে কৃত অপরাধ স্বীকার করে আজ লাইলাতুল কদর রজনীতে আল্লাহ্কে ডাকবে তারা ক্ষমা ও মুক্তির আশা অবশ্যই করতে পারেন। কেননা, এদের মুক্তির দুয়ার উন্মুক্ত করে আল্লাহ্ বারবার বলেছেন– ‘ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম’। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তবে দয়া ও অনুগ্রহ এমনিতেই পাওয়া যায় না। আল্লাহ্র কাছে রহমত ও নাজাতের জন্য দুহাত তুলে ফরিয়াদ তো করতেই হবে। আর মানুষের ফরিয়াদ, আর্জি ও আকুতি খুব বেশি করে আল্লাহ্র দরবারে মকবুল ও গ্রহণীয় হওয়ার মুহূর্ত লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর মানে সৌভাগ্য রজনী। এ মহিমান্বিত রজনীকে লাইলাতুল কদর নামে অভিহিত করার তাৎপর্য কী? এ সম্পর্কে সহীহ মুসলিম শরিফের টীকাকার ইমাম নববী (র.) লিখেছেন, এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর এ জন্যই রাখা হয়েছে যে, কদর মানে তাকদির ভাগ্য। আর এ রাতে মানুষের পরবর্তী এক বছরের তাকদির বা ভাগ্য রিজিক, জন্ম–মৃত্যু ইত্যাদি কর্তব্যরত ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করা হয়। এর আরেক ব্যাখ্যা হলো– কদর মানে সম্মান ও মর্যাদা। আর যেহেতু এ রাতের সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনেক বেশি তাই এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয়। (মুসলিম)।
লাইলাতুল কদর কোন রাত এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন– রাসুলুল্লাহ্ (দ.) ইরশাদ করেছেন : তোমরা লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো রমজানের শেষ দশকে বিজোড় রাতে (মিশকাত)। লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির লক্ষ্যে রমজানের শেষ দশকের রাতসমূহে ইবাদতে মশগুল থাকা উত্তম। তবে সাতাশতম রাতের ব্যাপারে নির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় এবং এ মোতাবেক যুগে যুগে মুসলমানরা লাইলাতুল কদর পালন করে আসছে। লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ্ (দ.) ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সাওয়াব বা পুণ্যের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখে তার পেছনের সব পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে ইবাদত করবে তার পেছনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (বুখারি শরিফ) তবে এ রাতে ব্যভিচারী, মদ্যপায়ী, সুদখোর, গণক, অপরের নিন্দাকারী, হিংসুক, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী ও মাতাপিতার অবাধ্য লোকদের দোয়া কবুল হবে না। খাঁটি নিয়তে অনুশোচনা ও তাওবা করলেই মুক্তির আশা করা যায়। অন্যের সম্পদ হকদারকে ফিরিয়ে না দিলে এ রাতেও মুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এ রাতে নফল নামাজ, দোয়া দরুদ, জিকির, কুরআন তেলাওয়াত, মাতা–পিতা ও মুরুব্বিদের কবর জিয়ারত এবং মহান অলী বুজুর্গদের মাজার শরীফ জিয়ারত করা ও দান সদকাহ করা অতীব উত্তম। এতে অধিক পুণ্য অর্জিত হয়। এ রাতে বেশি বেশি এ দোয়াটি পাঠ করা উত্তম। আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন করিমুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি ইয়া গাফুরু ইয়া গাফুরু, ইয়া গাফুর। ‘হে আল্লাহ্। আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা চাওয়া আপনি পছন্দ করেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’
আজ লাইলাতুল কদরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে মসজিদ–মাজারের আঙ্গিনায় জড়ো হওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর মাঝে বেশি বেশি দান সদকাহ করুন। এতে অশেষ পুণ্য মিলবে।
বড়ই বেদনাদায়ক যে, ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর আজ জঘন্য গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই পবিত্র রোজার মাসে ফিলিস্তিনের গাজার মুসলমানরা অনাহারে অর্ধাহারে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। একমুঠো খাবারের জন্য শিশুদের আর্তনাদে আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা আজ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শিকার। বিশ্বজুড়ে মানবতার দুরবস্থার এ দুঃসহ ক্রান্তিকালে হতভাগ্য মানুষের সৌভাগ্য ও মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করতে সবাইকে আল্লাহ্র দরবারে পুরোপুরি নিবেদিত ও সমর্পিত হতেই হবে। দেশ ও জাতির অগ্রগতি, মুসলিম উম্মাহর সমৃদ্ধি, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও মুক্তি এবং নিপীড়িত মানবতার সত্যিকার মুক্তি যেন আজ লাইলাতুল কদরের পুণ্যস্পর্শে সবার বরাতে জুটে আসুন সম্মিলিতভাবে এ মহিমান্বিত রজনীতে আল্লাহ্র দরবারে আকুল ফরিয়াদ ও আর্তি জানাই। আল্লাহ্ পাক সবাইকে লাইলাতুল কদর নসিব করুন। মহান আল্লাহর করুণাধারায় সবাই সিক্ত হোন। আমিন।
লেখক
সাংবাদিক; নির্বাহী পরিচালক, ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ