আজ লাইলাতুল কদর। পুণ্যময় রাত। এ রাতটি মুসলমানদের জন্য এক সৌভাগ্যের রাত। আল্লাহপাক যে একটি রাত ইবাদত বন্দেগিতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক সাওয়াব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে গৌরবময় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত। কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রাত।
সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে অর্থাৎ মাগরিব নামাজ থেকে শুরু করে সুবেহসাদিক তথা ফজরের নামাজ পর্যন্ত রহমতের ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে কর্তব্যরত থাকেন এবং মুমিন বান্দাদের ইবাদতের হিসাব আমলনামায় লিখতে থাকেন। লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ রাতেই মহান রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের সঠিক পথ নির্দেশনামূলক সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত ও কল্যাণ স্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন শ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব ‘আল কোরআন’।
কোরআনুল কারীমে আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তায়ালা এরশাদ হয়েছে, ‘আমি একে নাজিল করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। এ রাত(লাইলাতুল কদর) সম্পর্কে আপনি কী জানেন? কদরের রাত হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’। (সুরা আল কাদর : ১–৫)। অপর এক সুরায় উল্লেখ রয়েছে ‘নিশ্চয় আমি তা (কোরআন) এক মোবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়’। (সুরা আদ দুখান : ১–৪)।
সুরা কদর অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে ইবনে আবি হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন–একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সামনে বনী ইসরাঈলের জনৈক চারজন লোক সম্পর্কে আলোচনা করলেন যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করে অধিককাল যাবত ইবাদত করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তারা একটিও নাফরমানি করেননি। রাসুলুল্লাহর (সা.)এ নিকট থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং নিজেদের ব্যাপারে আফসোস করতে লাগলেন। সাহাবায়ে কেরামের এ আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে মহান রাব্বুল আলামিন হজরত জিবরাঈলের (আ.) মাধ্যমে রাসুলের (সা.) নিকট এমন সময় এই সুরায়ে ‘কদর’ অবতীর্ণ করেন। (তাফসিরে মাআরিফল কুরআন ও তাফসিরে মাজহারি)। যেন আখেরি জমানার শেষ নবীর উম্মতগণ অল্প হায়াতে বেশি নেক অর্জন করার সুযোগ পায়।
এ রাত অতি বরকতময় ও সম্মানিত হওয়ার কারণে সারারাত জেগে এবাদতে মশগুল থাকাই শ্রেয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘কদরের রাতে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী–পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (তাফসিরে মাজহারি)
মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি, হাদিস নং: ৬৭২)। এ লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানদের ধারনা ২৬শে রমজান দিবাগত রাতই লাইলাতুল কদর। কিন্তু কোরআন ও হাদিস দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট রাত লাইলাতুল কদর হিসেবে প্রমাণিত নয়। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতসমূহে তা খোঁজ করবে। (বুখারি, হাদিস নং :৭০৯)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)।
তাই আমাদের শেষ ১০ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোর প্রতি। একদা হজরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন রমজানের বেজোড় শেষের দশ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)।
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত–বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই।
আমাদের দেশে দেখা যায় কতিপয় মুসলিম অজ্ঞতাবশত এবাদতের চেয়ে এ রাতটিকে আনুষ্ঠানিকতায় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আল্লাহর জিকির আর এবাদতে মশগুল না থেকে আতশবাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। হেলায় ও আনন্দে এমন একটি রাতের ফজিলত থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত করুন। লাইলাতুল কদর তালাশ করে সঠিক ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে রাত যাপনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।