প্রবাহ

কচিদায়ে বুরদা: মিশরে রচয়িতার যেয়ারত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

মাউলা ইয়া সাল্লি ওয়া সাল্লিম দাইমান আবাদান

আলা হাবিবিকা খাইরিল খালকি কুল্লিহিমি

হে আল্লাহ! আপনি সদা সর্বদা দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন আপনার প্রিয়তমের উপর, যিনি পুরো সৃষ্টির সেরা।

মুহাম্মদ (.) দোজাহানের সর্দার, জ্বীন ও মানবজাতির সর্দার

আর আরবিঅনারবী দুই দলের সব শাখার সর্দার

তিনি এমন স্নেহময়, যার সুপারিশ আমরা কামনা করি

বিচার দিবসের করুণ অবস্থার জন্য

এরপর আমরা চাই, আপনি আবু বকর (.) ও উমর (.) এর উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান

এবং মহিমান্বিত আলী (.) ও উসমান (.) এর উপর

হে আল্লাহ পালনকর্তা! মোস্তফা (.) এর মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্যে সফল করুন

হে উদার দয়াবান! আমাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা দান করুন।

মহান আশেকে রাসূলগণের মধ্যে অনেকে নাতে রাসূল (.) লিখে গেছেন বিভিন্ন ভাষায় অথবা যার যার নিজস্ব ভাষায়। বাংলা ভাষায় নাত শরীফে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অদ্বিতীয় বলা যাবে। অপরদিকে উর্দু ফার্সির পাশাপাশি আরবিতেও অনেকে নাতে রাসূল (.) লিখে গেছেন। তৎমধ্যে কাসিদা বুরদা অন্যতম। আমাদের দেশে এ নাত শরীফের প্রচলন মোটামুটি। কিন্তু আরব দেশে বারে বারে এই নাত শরীফ শুনতে পাই খুবই আবেগী কণ্ঠে।

কসিদা বুরদার রচিয়তাকে আলবুসিরি বা ইমাম বুসিরি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তাঁর মূল নাম হযরত শরফুদ্দিন বুসিরি। পূর্ণ নাম হযরত শরফুদ্দিন আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন সাঈদ বিন হাম্মার বিন মহসিন আল বুসিরি। তিনি ১২১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ইন্তেকাল ১২৯৪ সালে। তিনি ছিলেন একজন আশেকে রাসূল সুফি দরবেশ। সাথে সাথে একজন মিশরীয় সুপ্রসিদ্ধ কবি। তিনি প্রচুর কবিতা রচনা করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে আলেম সমাজ ও শাসক গোষ্ঠীর নিকট ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।

শাযেলিয়া তরিকার অন্যতম মহান শায়খ হযরত আবুল আব্বাস আলমুরসির তিনি ছিলেন অন্যতম একজন মুরিদ। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে তিনি শায়িত।

আলেকজান্দ্রার দি গ্রেড এর নামকরণে এই শহরের নাম আলেকজান্দ্রিয়া। আরবি নাম ইসকান্দারিয়া। যা ভূমধ্যসাগরের তীরে কায়রো শহর থেকে প্রায় ২ শত কি.মি উত্তরে। অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরের তীরে এই শহরে মহান আশেকে রাসূল কাসিদা বুরদা রচয়িতা শায়িত রয়েছেন। মাত্র শত মিটারের দূরত্বে শায়িত রয়েছেন অপর মহান শায়খ হযরত আবুল আব্বাস আলমুরসি।

১৯৯৭ সালে রমজানের আগে আগে মাত্র সপ্তাহখানেকের জন্য মিশর সফর করা হয়েছিল। এই সময় আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়া হয়নি। এইবারে এক নাগাড়ে ১৩ দিনের মিশর সফরের প্রোগ্রাম করতে গিয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করি হযরত শরফুদ্দিন বুসিরি ও হযরত আবুল আব্বাস আলমুরসির যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। সে লক্ষে আমরা শারম আল শেখ থেকে ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার ২ রাতের প্রোগ্রামে দুপুরের Egypt Air ফ্লাইটে আলেকজান্দ্রিয়া রওনা হই। আমার কনিষ্ঠ পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক উদ্দিন চৌধুরী রিফাত আমার সাথে বারে বারে পরামর্শক্রমে তুরস্ক ও মিশর সফরে বিমান, ট্রেন, হোটেল বুকিং করিয়ে নেয়। রিফাত আমাদের সাথে তুরস্কে ৮ দিন থেকে দেশে ফিরে আসে। এডভোকেট ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, নুরুল ইসলামকে নিয়ে আমরা ইস্তাম্বুল থেকে কায়রো চলে যাই। পরপর ৫ রাত কায়রো অবস্থান করে ২২ তারিখ মঙ্গলবার আমরা টেক্সিযোগে সিনাই উপদ্বীপের তুরে সিনা হয়ে বিকেলে শারম আল শেখ পৌঁছি। কায়রো আবহাওয়া আরামদায়ক পেয়েছি। শারম আল শেখের তাপমাত্রা অসহনীয় মনে হয় ৩৪৩৮ ডিগ্রী উঠানামা করছে। তিন উপসাগরের মুখে শারম আল শেখ পর্যটন শহরের অবস্থান। আমরা এখান থেকে দুপুরের ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের ফ্লাইটে আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছি। Egypt Air মাঝারি আকৃতির বোয়িং/এয়ার বাস। আসন বিন্যাস একদিকে ৩ জন আরেকদিকে ২ জন করে। বিমান আকাশে উঠে গেলে বিমানবালা দ্রুততার সাথে আধা লিটারের এক বোতল করে পানি দিয়ে গেল। জাতীয় বিমানে খাবার দেয়া অনেকটা রেওয়াজ। বেসরকারি কোন বিমান খাবার দেয় কোন বিমান খাবার দেয় না। Egypt Air পানির বোতল দিয়ে আর কোন খবর নেই। আমার কাছে বিষয়টি কেমন জানি লাগল।

শারম আল শেখ থেকে Egypt Air আমাদেরকে নামিয়ে দিল আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ৬০/৭০ কি.মি দূরত্বে। এতে জানতে পারি ও বুঝতে পারি ভূমধ্যসাগরের তীরের এই এলাকা নিচু জলাশয় প্রকৃতির। ইসকান্দারিয়ায় রয়েছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর জামাল। তথায় বিয়ে করে বসবাসরত। তিনি আমাদেরকে দিক নিদের্শনা নিয়ে সহযোগিতা করছে। আমরা বিমান বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগরের তীরে বুক করা হোটেলে পৌঁছি। হোটেল থেকে হযরত শরফুদ্দিন বুসিরি ও হযরত আবুল আব্বাস আলমুরসি যেয়ারতে আসি।

শাযেলী তরিকতের ইমাম হযরত আবুল হাসান শাযেলী (রহ.)। তিনি হজ্ব করতে যেতে বা আসতে আসওয়ান ও লোহিত সাগরের মধ্যখানে ইন্তেকাল করলে তথায় শায়িত করা হয়। তাঁরই অন্যতম খলিফা হযরত আবুল আব্বাস আলমুরসি।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে আলেকজান্দ্রার মিশর জয় করেন। আলেকজান্দ্রারিয়া নগরী তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব ৩০ হতে ৩৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিশরে রোমান এবং ৩৯৫ হতে বাইজানটাইন শাসন চালু হয়। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ২য় খলিফা হযরত ওমর (.)’র আমলে মিশর ইসলামের ছায়াতলে আসে। আলেকজান্দ্রার দ্য গ্রেড যার নামে এই শহর তিনি ম্যাসিডোনিয়ার ব্যাসিলেউস, পারস্যের শাহেনশাহ, মিশরের ফারাও, এশিয়ার অধিপতি বলা হয়।

আলেকজান্দ্রিয়াকে আরবিতে ইস্কান্দরিয়া বলে। তেমনি আরব দেশও শহরের একাধিক নাম রয়েছে। যেমন কায়রো আরবিতে কাহেরা, সিরিয়া আরবিতে সুরিয়া, জর্ডান আরবিতে উর্দুন, আলজেরিয়া আরবিতে জাযাইর, মরক্কো আরবিতে মগরিব, এডেন আরবিতে আদন।

উভয় মাজারে যেয়ারতে মোটামুটি ভিড় প্রত্যক্ষ করি। আবুল আব্বাস মসজিদটি বড়। এই মসজিদকে আলেকজান্দ্রিয়ার কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভূমধ্যসাগরের তীরে আমরা পরদিন এই মসজিদে জুমা পড়তে আসি। আলেকজান্দ্রিয়া গরম অনুভব হচ্ছিল তাপমাত্রা ৩৪৩৬ ডিগ্রী হবে।

তুর্কি সুলতানগণ মিশর জয় করার পর ভূমধ্যসাগরের তীরে এ শহরে শীপ ইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের নিরাপত্তার কল্যাণে। এরপরও চট্টগ্রাম কর্ণফুলী শীপ ইয়ার্ড থেকেও শীপ কিনে নিয়ে যেতেন তুর্কি সুলতানরা। চট্টগ্রামের শীপগুলি দামে সস্তা, টেকসই, আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন। সময় স্বল্পতা তথ্যের অভাবে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তুর্কি শীপ ইয়ার্ডের কোন খবর পেলাম না। আলেকজান্দ্রিয়া হোটেলে ২ রাত অবস্থান করি। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আসওয়ান সরাসরি ফ্লাইট না পাওয়ায় সড়কপথে টেক্সি নিয়ে কায়রো বিমান বন্দরে চলে যাই। তথা হতে সন্ধ্যার ফ্লাইটে আসওয়ান রওনা হই।

হযরত বুসিরি অনেক কবিতা রচনা করে গেছেন। সেই যুগে তার মত খ্যাতিমান কবি আর কেউ ছিল না। তৎকালীন সময়ে আলেম সমাজ ও শাসক গোষ্ঠীর নিকট এই মহান ইমাম বুসিরি সম্মান ও শ্রদ্ধার অধিকারী ছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে অনেক কারামতের অধিকারী।

এই কাসিদার মূল নাম আল কাওয়াকিবুত দুররিয়াহ ফি মাদহি খাইরিল বারিয়াহ (শ্রেষ্ঠ মানবের প্রশংসার উজ্জ্বল নক্ষত্রমালা)। এই নামে কাসিদাটি প্রথম দিকে খ্যাতি লাভ করে। মূল নাম ছাড়াও কাসিদাটির আরও ২/১ টি নাম প্রচলিত আছে। আরেকটি নাম বুরয়াহ অর্থাৎ আরোগ্য। যেহেতু এই মহান সুফি, দরবেশ, কবি এই কাসিদার বদৌলতে আরোগ্য লাভ করেছিলেন। তাই এই নামকরণ। তবে এই কাসিদার সর্বাধিক পরিচিতি নাম ‘আল বুরদা’। বুরদা শব্দের অর্থ ঢোরাকাটা বা নকশী চাদর। নামকরণের একটি তাৎপর্য এই নকশী চাদর যেমন নানান রকম রং ও বিচিত্র নকশা থাকে তেমনি আল্লাহর রাসূল (.)’র প্রশংসায় এই কাসিদাতে বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে।

এই নামকরণের সর্বাধিক প্রচলিত তাৎপর্য এই যে, মহান সুফি, কবি স্বপ্নের মধ্যে এই কাসিদা শুনে আল্লাহর রাসূল (.) খুশি হয়েছিলেন। যার বরকতে তিনি রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন।

তিনি আলজেরিয়ার ডিলাস নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তবে মিশরের একটি জনপদের নাম বুসির। তিনি এখানে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন বলে নাম হয়ে গেছে বুসির। আরেক মতে বুসিরি তার লকব, বুসিরি কোন জায়গার নাম নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যাংক একীভূতকরণ এবং এর ভবিষ্যৎ
পরবর্তী নিবন্ধফলমন্ডিতে শোহাদায়ে বদর দিবসে খতমে বোখারী