আজ ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
এক সময় অটিজম ছিল একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। এ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা ও স্কুল সাইকোলজিস্ট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ২০০৭ সালে এ বিষয়ে দেশে কাজ শুরু করেন। সায়মা ওয়াজেদ এ অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে তাঁর অবদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ অটিজম আক্রান্ত। আমাদের দেশের সঠিক পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে ধারণানুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরো প্রায় দেড় হাজার শিশু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো–ডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা) ২০১৩ সালে দেশে অটিস্টিক শিশুদের অবস্থা নিয়ে মাঠপর্যায়ে প্রথম একটি জরিপ চালায়। সেখানে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৫টি শিশু অটিজম বহন করে বলে তথ্য উঠে আসে। ৪ বছর পর ২০১৭ সালে আরো একটি জরিপে দেখা যায়, ১০ হাজারে ১৭টি শিশু বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অটিজম শিশুদের বিকাশগত একটি সমস্যা। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা সাধারণত অপরের সাথে ঠিকমতো যোগাযোগ করতে পারে না, তারা অতিরিক্ত জেদী হয়ে থাকে এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও গুটিয়ে রাখার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। অটিজমের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। তবে গবেষকরা মনে করেন, জেনেটিক, নন–জেনেটিক ও পরিবেশগত প্রভাব সমন্বিতভাবে অটিজমের জন্য দায়ী। শিশুর বিকাশে প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সৃষ্টি হয়। এ পর্যন্ত পরিচর্যাই এর একমাত্র বিকল্প।
বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক শিশু অটিজম নামের এই নিউরো–ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত। ইতোমধ্যে এ সম্পর্কে পিতা–মাতা, পরিবার–পরিজন ও সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা ও যথার্থ পরিচর্যার জন্য বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। এই শিশুরা পৃথিবীকে আপনার–আমার চেয়ে আলাদাভাবে দেখে। এরা খুব ভালো পর্যবেক্ষক। আশপাশের বহু কিছুই তারা পর্যবেক্ষণ করে। ভালো আচরণ, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে তাদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অটিজম ও এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনব্যাপী সেবার প্রয়োজন হয়। মাত্রাভেদে অনেকেই অন্যের সাহায্য ছাড়া জীবন অতিবাহিত করতে পারে না বিধায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ পুনর্বাসন ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয় উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, উপযুক্ত শিক্ষা–প্রশিক্ষণ, দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি।
নিশাত শাহরিয়ার তাঁর এক লেখায় বলেছেন, অনেক সময় বলা হয়, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতীয় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা একা থাকতে পছন্দ করে কিংবা তারা সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায় না। আসলে বিষয়টি তা নয়। তারা প্রায়ই সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে চায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগে প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে তারা তা করতে পারে না। কখনো কখনো তারা বন্ধুত্বও তৈরি করতে পারে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোনো কোনো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কথা বলতে পারে এবং অন্যের সঙ্গে মিশতেও পারে। তাদের বাচনিক অথবা অবাচনিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে তারা মেধাবী, সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং চিন্তার দিক থেকে তারা সক্ষম থাকতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেকেই জীবনে সফল হতে এবং সমাজে অবদানও রাখতে পারে। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্নরা সহানুভূতিপ্রবণ। আবার নিজেও অন্যের কাছে স্নেহ পেতে চায়। তবে প্রক্রিয়াগত কারণে এবং সামাজিক বিষয় বোঝার পার্থক্যের কারণে সাধারণের চেয়ে তাদের প্রকাশভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন হয়। তাই তাদের প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে হবে।