বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ২০১৯ সালে জারি করা বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিত করে দিয়েছে হাই কোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের হাই কোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এই আদেশ দেয়। এর ফলে দেশে প্রকৌশল শিক্ষার শীর্ষ এ বিদ্যাপীঠে ছাত্র রাজনীতি চর্চায় আর কোনো বাধা থাকছে না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, কোর্ট যেটা বলবে আমাদের সেটা মানতে হবে। কোর্টের আদেশ শিরোধার্য। আদালত অবমাননা আমরা করতে পারব না। আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়তে উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। খবর বিডিনিউজের। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক সমাবেশ ঘটানোর অভিযোগে হল থেকে বহিষ্কৃত ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বী হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন। তার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট হারুনুর রশিদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ।
অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক পরে বলেন, ২০১৯ সালের বিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিত করায় বুয়েটে রাজনীতি করায় আর বাধা থাকল না।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে’ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ অনেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম এ সমাগম ঘটান। এ ঘটনায় শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ দেখান। পরে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন।
এরপর রাতে বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ফোরকান উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন করে ৮ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
এর মধ্যে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে পাল্টা কর্মসূচি দেয় ছাত্রলীগ। রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা অবিলম্বে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর অনুমতি দেওয়ার দাবি জানায়। পরে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার রোববার সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্র রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হবে। তখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা যদি পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তাদের আবার উদ্যোগী হতে হবে।
উপাচার্য বলেন, রাজনীতি না করলে শিক্ষার্থীদের চোখ খুলবে না, দেশের প্রতি তাদের প্রেম আসবে না। এই বিষয়গুলো তারা (শিক্ষার্থী ও শিক্ষক) চিন্তা করে যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে (ছাত্র) রাজনীতি ওপেন হতে পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা রাজনীতি করতেই হবে–এমন তো কাউকে জোর করতে পারব না। তারা যদি নিজ থেকে উদ্যোগ নেয় আমরা শিখতে চাই, করতে চাই, প্র্যাকটিস করতে চাই, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে; আমরাও করতে চাই। তাদের যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে তারা চালু করতে পারে, এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
এদিকে ছাত্র রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গতকাল সোমবার হাই কোর্টে রিট মামলা করেন হল থেকে বহিষ্কৃত ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বী। তার আবেদনের শুনানি করেই নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করার পাশাপাশি রুল জারি করে হাই কোর্ট বেঞ্চ। ছাত্র রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ওই বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে অটল বুয়েট শিক্ষার্থীরা চান আইনি লড়াই : বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়তে উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে আদালতের আদেশের পর বিকালে বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এ আহ্বান করেন তারা। তিনজন শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। তারা নিজেদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করেননি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার জরুরি বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাই কোর্ট। আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও আস্থা রাখি। আমাদের মাননীয় ভিসি স্যারকে এই আর্জি জানাচ্ছি, তিনি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষককে নিয়ে আপামর বুয়েট শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাঙ্ক্ষা, তা সকল আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে পূরণ করেন।
বিচার বিভাগের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আমরা বুয়েট প্রশাসনের কাছে দাবি রাখব, এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বিচার বিভাগে যথাযথভাবে তুলে ধরা হোক। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না থাকার যে দাবি, তার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং অটল।
রাজনীতির বাধা কাটার পর উচ্ছ্বসিত একদল শিক্ষার্থী : বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে হাই কোর্ট যে আদেশ দিয়েছে, তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন শিক্ষালয়টির একদল শিক্ষার্থী। গতকাল বিকালে কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু‘, ‘আজকের এই দিনে নেতা তোমায় পড়ে মনে’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
এই শিক্ষার্থীরাই শনিবার দাবি করেছিলেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও গোপনে হিযবুত তাহরীর, ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।