জাতীয় নির্বাচন এর পর হয়ে গেলো মেয়র পদে নির্বাচন। হয়ে গেলো আইনজীবী সমিতির নির্বাচন। আদৌ কি আগ্রহ ছিল মানুষের না আছে? কেউ কি আসলেই এসব নিয়ে ভাবে? আজকাল কেউ এসব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমরা যারা দীর্ঘ সময় ধরে কলাম লিখি বিশেষত রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করি বলে সবাই মনে করেন, আমাদের ভাবনার জগতেও পরিবর্তন এসেছে। অন্তত আমার মনে হয় পাঠককে এমন কিছু নিয়ে বলা দরকার বা লেখা উপহার দেয়া দরকার যা প্রচলিত ও নোংরা রাজনীতির বাইরের কিছু।
এই যে মানুষের নির্বাচন উদাসীনতা, আগুনে পোড়া মানুষের ব্যাপারে নির্বিকার বা ভাবলেশহীন এর কারণ কি? আজকাল কোন বিষয়ই কয়েক দিনের বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যতো কঠিন বা নির্মমই হোক মানুষ তা হজম করতে শিখে গেছে। আসলে কি শিখে গেছে না শিখতে বাধ্য হয়েছে? প্রতিকারহীন প্রতিবাদ টেকে না। উচ্চকিত কন্ঠ কখনোই দীর্ঘ মেয়াদী হয় না। তাতে গলা ফেটে যাতে পারে। অসুস্থতা হতে পারে। ফলে কন্ঠস্বর উঁচু থাকতেই তার প্রতি মনযোগ দরকার। যেহেতু সে সম্ভাবনা থাকে না মানুষ তাই কন্ঠ ছাড়তেও ভুলে গেছে।
এ সব মিলিয়ে যা বাস্তবতা তার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের যোগ নিবিড়। আমাদের ধারণা অসুখ মানে সর্দি কাশি জ্বর ডেঙ্গু বা সামপ্রতিক সময়ের মহামারি কোভিড। এগুলো মারাত্মক অসুখ। এর নিরাময় ও করতে জানে মানুষ। করোনা মহামারির আতংকিত পৃথিবী ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসব অসুস্থতা প্রতিকারে জান বাঁচাতে উদ্বিগ্ন মানুষ তার মনোজগত নিয়ে অতটা ভাবে না। অথচ এই মনোজগত বা মানসিক সুস্থতা না থাকলে মানুষের আর কোন কিছুই কিছু না। সবকিছু ধীরে ধীরে মূল্যহীন হয়ে পড়লেও আমরা বাঙালিরা পৃথিবীর কোথাও এ নিয়ে তেমন ভাবি না।
কেমন আছে দেশের মানুষের মন? কতটা সুস্থ ও সবল মানসিকতা নিয়ে বাঁচছেন মানুষ? বাংলাদেশের অন্তত ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ নেই কিংবা সংকটাপন্ন। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেপিয়েন ল্যাবস প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সেপিয়েন ল্যাবস প্রকাশিত ‘মেন্টাল স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন–২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে বিশ্বের ৭১টি দেশের মধ্যে ৫৩ তম অবস্থানে আছে। এই গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশের মেন্টাল হেলথ কোশেন্ট বা এমএইচকিউ স্কোর ৬২। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে পীড়িত বা সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।
বিশ্বের ৭১টি দেশের ১৩টি ভাষার মোট ৫ লাখ লোকের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সেপিয়েন ল্যাব। প্রতিবেদন অনুসারে, জরিপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি সুস্থ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটির মাত্র ১৪ শতাংশ লোক মানসিকভাবে পীড়িত বা সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়া এই তালিকার শীর্ষের কয়েকটি দেশ হলো ইতালি, জর্জিয়া, নাইজেরিয়া ও আর্মেনিয়া। আর তলানিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ আছে উজবেকিস্তান। এর পরপরই আছে, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও তাজিকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়েও নিচে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ৬০ ও ৫৫। এই দুটি দেশে যথাক্রমে ৩০ ও ২৮ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে পীড়িত কিংবা সুস্থ থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের সমাজে মায়া মমতা আর পাশাপাশি থাকার রেওয়াজ উঠে যায় নি। ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট খুলনার মতো বড় বড় কয়েকটি শহর বাদ দিলে সমাজ ও জীবনে মানুষ মানুষের কাছকাছি মায়ার এক জগতেই বসবাস করে। আমরা যারা প্রবাসী আমরা জানি একাকীত্ব কা‘কে বলে। বিশেষ করে মধ্য বয়সে যারা দেশ ছেড়ে আসেন তাদের অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা। আমরা না পেরেছি ক্লাব কালচার নৈশ জীবনে মিশতে না পারছি পরিপূর্ণ বাঙালি জগতে বাস করতে। আমার ধারণা অভিবাসী দেশগুলোর বাংলাদেশিদের নিয়ে জরিপ চালালে তার ফলাফল হবে শোচনীয়। সে দিক থেকে অভাব অনটন রাজনৈতিক অচলায়তনের পর ও দেশের মানুষ ভালো আছেন বলে ধরে নেয়া যায়। জরীপের যে ফলাফল আমরা দেখছি তাতে এটা স্পষ্ট দেশ ধনী হলে ই মানুষ সুস্থ থাকে না। তার মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে মন ও মেজাজের ওপর। তার সঙ্গ তার বিনোদন তার আড্ডা তার সময় কাটানো সব মিলিয়েই তার ভালো থাকা। সে দিক থেকে বাংলাদেশ খারাপ নাই। জরীপে তলানীতে থাকা আমেরিকা ব্রাজিল আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। আমাদের দুই প্রতিবেশী ভারত পাকিস্তানের চাইতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভারত একটি আর্থিক উন্নতির দেশ নামে পরিচিত নব্য শক্তি হবার পর ও তাদের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের হাল জটিল। যার মানে আত্মকেন্দ্রিক আর অর্থ নির্ভর ছূতে চলা সমাজে আর যাই থাক মানসিক শান্তি থাকে না। থাকার কথা ও না। সমপ্রতি ধন কুবের আম্বানী পরিবারের বিয়ে যে তুমুল হৈ চৈ আর বিলাসিতার প্রচার তার দিকে তাকালেও জবাব মিলবে। এভাবে বিলাসিতা এক্সপোজড করার নাম ও দারিদ্রতা। কেউ একবারের জন্য ও ভাবে নি এর ফলে সমাজে কি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানসিক সুস্থতার জন্য দরকার সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন এক সমাজ। এসব বিয়ে শাদি দেখার পর কোন বালক বালিকা বা তরুণ তরুণী গবেষক কিংবা বিজ্ঞানী হতে চাইবে? সমাজে বিত্তের প্রয়োজন সর্বাধিক হলেও তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ই সভ্যতা। ভারতের ফলাফল তাই আমাকে অবাক করে নি। আর পাকিস্তানের কথা তো বলাই বাহুল্য। আম জনতা যে সেখানে এখনো সুস্থ আছেন এটাই যথেষ্ট।
অথচ জরিপ বলছে বিধ্বস্ত অর্থনীতির দেশ মাত্র ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের মানুষজন আবারো দেশ গঠনে কাজ শুরু করেছে। ওরাই কি না সুস্থতার শীর্ষে থাকা অন্যতম দেশ। কিভাবে সম্ভব? শান্তি উন্নয়ন আর নিয়ন্ত্রণ যদি সমার্থক না হয় এমনটা হতে পারে না। বিধ্বস্ত দেশটিতে জনগণ রাজপ্রাসাদে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছিল অধচ আজ তারাই মানসিক ভাবে সুস্থতায় এগিয়ে। আমাদের দেশের কথায় ফিরি। উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। মানুষের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। সিন্ডিকেট রাজনীতি আর হঠাৎ ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে ওঠাদের দৌরাত্ম্য না থাকলে মানসিক শান্তির স্তর আরো অনেক উপরে হতে পারতো। আমার ধারণা মানসিক সুস্থতার প্রধান প্রতিবন্ধক মানুষের লালসা। যা জন্য দায়ী অতিরিক্ত তথ্য প্রবাহ। যা তার দরকার নাই তাও জানছে যা দরকার তা পাচ্ছে না। ডিজিটালের এই বায়বীয় জগত মানুষের মনের অসুখ বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষত তারুণ্য এর শিকার ।
অনেক পথ যেতে হবে আমাদের। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষকে মাসনিক অবসাদ বা অসুস্থ রেখে জাতি ভালো থাকতে পারবে না। এই দিকটির দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। শুধু সরকার বা প্রতিষ্ঠান নয় ব্যক্তি পরিবার সমাজ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জানতে হবে তাদের ঘরের মানুষ পরিবারের মানুষ , প্রতিবেশী সমাজের সবাই কেমন আছেন? কেমন চলছে তাদের দিনকাল? এই জানা আগে বেশি ছিল বলে সুস্থতাও ছিল অধিক। মানুষে মানুষে যোগাযোগ যন্ত্রহীনতায় এর সুফল পাওয়া সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের মনযোগ এখন সময়ের অন্যতম চাহিদা।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।