মুক্তিযুদ্ধে কোন একক পরিবারের অবদান নির্ণয়ের প্রশ্ন আসলে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিল্পপতি এ কে খান পরিবারের নামই সবার আগে চলে আসে। এ কে খান মুসলিম লীগের সমর্থক হলেও একজন উদার, অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত মনের পরিশীলিত রুচির মানুষ ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার দাবিদার হয়েছিল। কিন্তু একজন বাঙালি নেতা পাকিস্তানের শাসক হবেন সেটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তার পশ্চিম পাকিস্তানি দোসররা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তারা জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নানা টালবাহানা শুরু করলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে চরম হতাশা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কে খানের মতো উদারপন্থী রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিও ব্যাপারটা পছন্দ করেননি।
১৯৭১ এর ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্বাহুত সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দিলে বাংলাদেশের মানুষ চরম বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বাংলার জনগণ ঘরবাড়ি, অফিস–আদালত ছেড়ে রাজপথে নেমে এসে স্লোগানে স্লোগানে অগিগলি রাজপথ, হাট–ঘাট–মাঠ–প্রান্তর মুখরিত করে তুললে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ বজ্রনির্ঘোষে সেই একটি দিনেই পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলো। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে সেদিনই শুরু হয়। “তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ”, “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা–মেঘনা–যমুনা”, “সব কথার শেষ কথা– বাংলার স্বাধীনতা”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর– বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “তোমার নেতা আমার নেতা– শেখ মুজিব শেখ মুজিব” ইত্যাদি স্লোগান শত সহস্র জনতার স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে যায় বাংলাদেশ।
কেউ কাউকে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি; তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মানুষ– লাঠিসোটা হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে মিছিলে সামিল হয়েছে; সে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে বাংলাদেশ পরিব্যাপ্ত করে ফেলে।
৭১–এর মার্চ–রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনার বারুদে ঠাসা একটি মাস– এমন মাস বাঙালি জীবনে আগে কখনো আসেনি, পরেও হয়তো আর আসবে না। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নির্দেশে ’৭১–এর মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছিল। গভর্নর হাউস এবং ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না। দেশে সে সময় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে কোন বিবেকবান মানুষের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। এ কে খান দেশে উদ্ভুত এ নতুন পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি রেখে চলেছিলেন এবং তিনিও মনে মনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হউক সেটা চেয়েছিলেন। তাঁর জামাতা এম আর সিদ্দিকী চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য এবং ’৭০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর ছেলেরাও বিশেষ করে বড় ছেলে জহির উদ্দিন খান ও মেজ ছেলে এ কে শামসুদ্দিন খান ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশ্যে জনমত তৈরি হতে থাকলে তারাও সেই নব জাগ্রত জাতীয় চেতনার স্রোতে অবগাহন করে চিন্তায়, চেতনায় ও মননে স্বাধীনতা সংগ্রামী হয়ে উঠেছিলেন।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর সেই ঘোষণা দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতারের চান্দগাঁও ট্রান্সমিশন সেন্টার দখল করে সেখান থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। সে সময় একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে বেতারে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচারের প্রয়োজন অনুভূত হলে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট রেজিমেন্টের উপ–অধিনায়ক মেজর জিয়া, যিনি তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণকারী বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন এবং বিদ্রোহ করার পর যিনি বোয়ালখালী ও পটিয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করছিলেন, তাকে সেখানে গিয়ে বেতারে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাটি দেওয়ার জন্য রাজি করান। তিনি ২৭ মার্চ বেতার কেন্দ্রে এসে নিজেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে এমন একটি বিতর্কিত ভাষণ দেন, যা শুনে তুমুল বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময়বিমূঢ় জাতি স্তব্ধ এ স্তম্ভিত হয়ে যায়। এ কে খান সাহেবও জিয়ার ভাষণটি শুনে খুবই মর্মাহত ও তাজ্জব হয়ে যান। তিনি তখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার ও মির্জা আবু মনসুরকে ফোন করে বলেছিলেন, দুনিয়ার মানুষ জানে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। শেখ মুজিবের দল নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র তিনিই তো স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অধিকার রাখেন। বেতারে তাঁর নামেই তো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা। এখন কোথাকার এক মেজর রেডিওতে ভাষণ দিয়ে বলল, সে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান। একথা কে বিশ্বাস করবে বা কে মানবে? জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হওয়ার তার ভাষণ মনে মনে হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কোন অভ্যুত্থান হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ জিয়া তো সেনাবাহিনীরই লোক। আর এ ধরনের ঘোষণা দেওয়ার অধিকার থাকে একমাত্র জনপ্রতিনিধির। এ কে খানের প্রতিক্রিয়া শুনে কায়সার তাকে বলেছিলেন, তাহলে আমরা এখন কি করতে পারি? তখন এ কে খান বলেছিলেন তোমরা জিয়াকে দিয়ে আরেকটা সংশোধিত ঘোষণা দেওয়াতে পার। যেখানে তিনি বলবেন যে শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা এবং শেখ মুজিব ইতিমধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন; সংশোধিত ঘোষণাটা জিয়া আবার পাঠ করবেন। তখন কায়সার তাকে বলেছিলেন তাহলে আপনিই সংশোধিত ঘোষণাটি লিখে দিন, আমরা জিয়াকে দিয়ে পাঠ করাব।
এ কে খান বললেন, আমি ফটিকছড়ির দৌলতপুরে আমার শ্বশুর বাড়িতে আছি। তোমরা এখানে এস, আমি লিখে দেব। সে রাতেই আতাউর রহমান খান কায়সার, মির্জা মনসুর ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন দৌলতপুরে এ কে খানের শ্বশুর আবদুল বারী চৌধুরীর বাড়িতে যান। তিনি তাদেরকে ডিটেকশন দেন, তারা তা লিখে নেন এবং রাতেই সংশোধিত ঘোষণাটি নিয়ে শহরে ফিরে আসেন। পরদিন জিয়াকে খুঁজে বের করে তাকে দিয়ে আবার সংশোধিত ঘোষণাটি রেডিও থেকে পাঠ করান। সংশোধিত ঘোষণায় জিয়া বলেন “…. On behalf of our Great Leader, The Supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman”, –জিয়ার এ ভাষণের পর তাঁর প্রথম ভাষণ নিয়ে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির অবসান ঘটে। যদিও ৭৫–এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতাসীন হয়ে কিছুদিনের মধ্যে জিয়া বিএনপি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করলে সে দলের নেতারা জিয়ার একাত্তরের ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রদত্ত ভুল ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে এবং কণ্ঠে আগের সেই জোর না থাকলেও আজো সুযোগ পেলে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তুলে ধরতে কখনো ভুল করে না। অবশ্য জিয়া স্বাধীনতার পর কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেনি।
যাহোক, নতুন রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে একটি ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি নিরসনে সহযোগিতা করে এ কে খান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।
এ কে খানের পুত্র জহির উদ্দিন খান এবং শামসুদ্দিন খান দু’জনই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে যান এবং প্রবাসী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। শামসুদ্দিন খান স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে খবর পাঠ করেন। জহিরউদ্দিন খান লন্ডনে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত ও তহবিল সংগ্রহ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে এ কে খান পরিবার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এ কে খানের ভাই এম আর খান, যিনি প্যারেড ময়দানের উত্তর–পূর্ব কোণায় থাকতেন, তিনি এবং তাঁর তিন পুত্রকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, তাদেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী এ কে খানের ভাইয়ের নাম মাহবুবুর রহমান খান (এম আর খান), তাঁর তিন শহীদ পুত্রের নাম হচ্ছে–শফিকুর রহমান খান, আজিজুর রহমান খান ও শমসের রহমান খান। ২৩ এপ্রিল, যেদিন তাঁদেরকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বন্দুকের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, সেদিন তারা এ কে খান ও এম আর সিদ্দিকীর খোঁজেই এসেছিলো। তাদের খোঁজ বের করার জন্যই তাদেরকে সার্কিট হাউসে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুসিক নির্যাতন চালায়। কোন কথা বের করতে না পেরে দু’দিন পর চারজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে অবশেষে গুলি করে নিস্তব্ধ করে দেয়। শফিকুর রহমান লন্ডনে পড়াশোনা করার পর মেসার্স কমার্শিয়াল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। আজিজুর রহহমান খান মহসিন কলেজে পড়তেন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং শমসের রহমান খান চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুলে অস্টম শ্রেণিতে পড়তো।
এম আর খান থাকতেন প্যারেড ময়দানের উত্তর পূর্ব কোণায় তাঁর শহরের নিজস্ব বাসভবনে। সেই বাসভবন থেকে তাঁর তিন পুত্রসহ তাঁকে ৭১–এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করে কোথায় যে লাশগুলো গুম করে ফেলেছে, সেটাও জানতে দেয়নি মিসেস এম আর খান এবং তাঁর অন্য পুত্র কন্যাদের। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হাবিবুর রহমান দুলাল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও তৎকালীন ছাত্রনেতা ও পরবর্তীকালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু এবং ঘাটফরহাদবেগের কমান্ডার এসএম মাহবুবুল আলমের গ্রুপে কাজ করতেন। দুলাল–এরও খোঁজ করেছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তিনি সতর্ক ছিলেন এবং পাকবাহিনীর আগমনের আভাস পেয়ে তিনি বাড়ির সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে পালিয়ে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এম আর খান ও তাঁর তিন পুত্র নিহত হওয়া সম্পর্কে স্বাধীনতার পর ইস্টার্ন এক্সামিনার পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে শহীদ মাহবুবুর রহমান খানের স্ত্রী আয়েশা খানম বলেন, তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে হজে গিয়েছিলেন। মার্চের ১২ তারিখে তিনি হজ থেকে ফিরে আসেন। এরপর ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৭ মার্চ তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে মোহরায় গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তখন সেখানে কালুরঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদিকে ৩০ মার্চের পর চট্টগ্রাম শহরও পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ১১ এপ্রিল কালুরঘাট পাঞ্জাবিদের দখলে চলে যায়। ১৭ এপ্রিল মাহবুবুর রহমান খান তাঁর পরিবার নিয়ে আবার শহরের বাসায় চলে আসেন। এদিকে শহরে তখন কারফিউ চলছিলো। ২৩ এপ্রিল সাঈদ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের বাসায় ঢুকে এ কে খান এবং এম আর সিদ্দিকীর খোঁজ করেন।
মাহবুবুর রহমান খান ঐ সময় বাসায় ছিলেন না। তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। মসজিদ থেকে বাসায় ফিরে তিনি পাকিস্তানি আর্মি আসার সংবাদ পান। ক্যাপ্টেন সাঈদ তাকে সার্কিট হাউসে যেতে বলে গিয়েছিলেন। পরদিন দুপুর দেড়টার মাহবুবুর রহমান তাঁর তিন পুত্র–শফিকুর রহমান, আজিজুর রহমান এবং শমসের রহমান খানকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যান। ৬টা ৫০ মিনিটে দিকে তারা বাসায় ফিরে আসেন। কিন্তু এক কাপ চা খেতে না খেতেই পাকিস্তানি বাহিনী এসে আবার তাদেরকে বন্দুকের মুখে ধরে নিয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন সাঈদ মাহবুবুর রহমান এবং তাঁর তিন সন্তানকে কোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে জনৈক ব্রিগেডিয়ারের সাথে দেখা করানোর জন্য তাদের তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। কোর্ট থেকে ক্যাপ্টেন সাঈদ তাদেরকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নিয়ে যায় জনৈক মেজর হাকিমের সঙ্গে দেখা করানোর জন্য। সেখানে তাদের সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাখা হয়। তারপর তাদের বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়। পরে ক্যাপ্টেন সাঈদ শহীদ মাহবুবুর রহমান ও তাঁর তিন পুত্র শফিকুর রহমান খান, আজিজুর রহমান খান এবং শমসের রহমান খানকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে তাদেরকে মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন শহীদ, ক্যাপ্টেন মমতাজ এবং ক্যাপ্টেন সাঈদ এ কে খান ও এমআর সিদ্দিকীর খোঁজ দেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে। আটক অবস্থায় অমানুসিক নির্যাতন চালিয়ে মাহবুবুর রহমান ও তাঁর তিন পুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় তিন ভ্রাতার ওপর নির্যাতন এবং তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করার করুণ কাহিনী প্রকাশিত হয়।
চান্দগাঁও রিলে স্টেশন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের ট্রান্সমিটারটি দেওয়াল ভেঙে যারা বের করে নিয়ে যান, তারা এ কে খানের ভ্রাতুষ্পুত্র আওয়ামী লীগ নেতা সেকান্দর খান ও তাঁর ভাই তমদ্দুন মজলিশ নেতা (পরে জাতীয় পার্টির এমপি) হারুনুর রশিদ খান। তারা সেদিন সাহায্য না করলে স্বাধীন বাংলা বেতারের ট্রান্সমিটার ভারতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলি, সে ফ্রন্টও খোলা সম্ভব হতো না।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি–সংগঠক।