হাত উঁচিয়ে কিংবা লেজার লাইট জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেয়ার অবস্থা থেকে বের হতে পারলো না নগরীর ট্রাফিক বিভাগ। ঈদকে সামনে রেখে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থায় ভয়াবহ রকমের চাপ পড়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির হয়ে পড়ছে সড়ক। এছাড়া ব্যস্ততম কয়েকটি পয়েন্টে সিডিএর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণেও সড়কে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। নগরীর ট্রাফিক সিস্টেমে বিশ্বমানের করার একটি প্রকল্প বহুবছর ধরে ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে। অটো ট্রাফিক সিগন্যালিং প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলেও ট্রাফিক সার্জেন্টদের হাতে লেজার লাইটের ব্যবহার বেড়েছে।
সূত্র বলেছে, দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাস্তার পরিমাণ খুবই কম। এমন ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিপুল জনসংখ্যার প্রায় মেগাসিটির কাছাকাছিতে ঠেকা একটি শহরে রাস্তার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ থাকার দরকার ছিল। একটি বিশ্বমানের বাসযোগ্য শহরে রাস্তার অনুপাত নিয়ে কখনো আপোষ করা হয় না। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাস্তার পরিমাণ ৯ শতাংশেরও কম। রাস্তার পরিমাণ কমে যাওয়ার পাশাপাশি যানবাহনের বেপরোয়া সংখ্যা বৃদ্ধি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শহরের প্রধান সড়ক বলতে বুঝায় বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটিকে। এশিয়ান হাইওয়ে খ্যাত এই রাস্তাটির কোথাও ছন্দপতন ঘটলে তার প্রভাব শুরু হয় নগরজুড়ে। এছাড়া অলংকার মোড় থেকে ট্রাংক রোড, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্যান্ড রোড, কাপাসগোলা রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোডসহ পাঁচ শতাধিক পিচ ঢালা রাস্তা রয়েছে। এর বাইরে ইট বিছানো রাস্তা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৬শ, কাঁচা রাস্তা রয়েছে ৬শ’র কাছাকাছি। নগরীতে সর্বমোট এগারোশ কিলোমিটারের মতো রাস্তা রয়েছে। এসব রাস্তার মধ্যে পিচের রাস্তাগুলোতে গাড়ি বেশি চলাচল করে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় দেড়শটি ক্রসিং বা মোড় রয়েছে। চৌরাস্তা এবং তিন রাস্তার এসব মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। কয়েকটি পয়েন্টে আরো আগেভাগে দায়িত্ব নিতে হয়, থাকতে হয় রাত ১১টার পরেও। বিশেষ করে স্কুল এবং নাইট কোচ ছাড়ার স্থানগুলোতে সময় মেপে দায়িত্ব পালন করা যায় না বলেও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে চারটি জোনে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম চলে। এরমধ্যে উত্তর বিভাগে ২৮০ জন, দক্ষিণ বিভাগে ২৬৫ জন, পশ্চিম বিভাগে ২০৩ জন এবং বন্দর বিভাগে ২০০ জন মিলে প্রায় সাড়ে নয়শ ট্রাফিক পুলিশ শহরের দুই লাখেরও বেশি গাড়ি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশের বিরুদ্ধে বহু ধরনের অভিযোগ থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে ভয়াল যানজট সামলাতে এক একজন পুলিশ সদস্যকে হিমশিম খেতে হয়।
নগরীর বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে। সিগন্যালগুলোতে একসময় অটো লাইটও লাগানো হয়েছিল। বছর কয়েক আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরকে সামনে রেখে ওই সময় প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে ১০টি মোড়ে ডিজিটাল ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ১৫টি মোড়ের হ্যালোজেন লাইটিং সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। সংখ্যার কাউন্ট ডাউনের মাধ্যমে রাস্তা পারাপার নিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম সম্বলিত এই ট্রাফিক সিগন্যাল সৌন্দর্য বর্ধন করেছে ঠিকই কিন্তু এক দিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন লাইটগুলো রাতে–দিনে হরদম জ্বলাজ্বলি করলেও পরবর্তীতে এগুলোর আর হদিশও থাকেনি। শহরের কোথাও অটো ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, ট্রাফিক পুলিশই হাতের ইশারায় কিংবা লেজার লাইটের সংকেত দিয়ে যানবাহন পরিচালনা করছে।
সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম মাহানগরীর যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। অন্যদিকে সিগন্যাল বাতি লাগানোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশন এবং পুলিশের সমন্বয়ের কোনো অভাব ঘটলে পুরো প্রক্রিয়াটি মাঠে মারা পড়ার উপক্রম হয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একটি সূত্র জানায়, ১৯৮৯–৯০ সালে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সিগন্যাল বাতি লাগানোর মাধ্যমে নগরীতে সিগন্যাল লাইট স্থাপন শুরু করেছিল সিটি কর্পোরেশন। গত দুই যুগে নগরীর সর্বমোট ৪২টি মোড়ে সিগন্যাল লাইট স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের অভাবে ট্রাফিক লাইটগুলোর কার্যকারিতা নেই বলেও তিনি স্বীকার করেন।
নগরজুড়ে যান চলাচলের নাজুক অবস্থার মাঝে বছর কয়েক আগে অটো ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। সড়কজুড়ে মাপজোকও করা হয়। বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও হয়। অটো সিগন্যালিং চালু করার জন্য ব্যাপক তোড়জোড় চালানো হলেও দীর্ঘদিনেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
ট্রাফিক সিগন্যালিং ঠিক না থাকা নগরীর যানজটের অন্যতম একটি প্রধান কারণ বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনা গেলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ দৈনিক আজাদীকে জানান, আগের প্রকল্পটি নেই। এখন নতুন করে একটি প্রকল্প গ্রহণ করার ব্যাপারে আমরা সার্ভে শুরু করেছি। জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের উপর প্রকল্প গ্রহণ করে ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ধারণক্ষমতার তিনগুণ মানুষ বসবাস করি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ সামলানোর মতো রাস্তা আমাদের নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে রাস্তা যা আছে তার এক তৃতীয়াংশ দখল হয়ে থাকে। যানবাহন চলাচল করে বাকি দুই তৃতীয়াংশে। রাস্তার উপর অবৈধ দখলদারিত্ব ঠেকানো গেলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, পিক আওয়ারে যানজট পৃথিবীর সব বড় শহরেই আছে। আপনি মস্কো বলেন, আমেরিকা বলেন, সিংগাপুর কিংবা হংকং বলেন সব শহরেই যানজট হয়। তবে সাধারণ মানুষের চলাচলটা নির্বিঘ্ন করতে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো গেলে যানজটের দাপট কমে যেতো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।