শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেইসঙ্গে ওই শিক্ষার্থীকে অসহযোগিতা করায় বিভাগের প্রধান জুনায়েদ আহমদ হালিমকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জানান। খবর বিডিনিউজের।
ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭–১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম সমপ্রতি অভিযোগ করেন, তার কোর্স শিক্ষক প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডেকে ‘যৌন হয়রানি’ করেন। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করায় বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ আহমদ হালিম তাকে ‘ফেল করিয়ে দেন’ বলেও মিমের অভিযোগ।
এক শিক্ষক ও সহপাঠীকে দায়ী করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনার মধেই মিমের এমন অভিযোগ নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
মিম বলেন, ‘প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে অ্যাকাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডাকেন এবং সে সময় ‘যৌন হয়রানি’ করেন। সেদিন তিনি আমাকে কুপ্রস্তাব দেন। কুপ্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না। প্রস্তাব দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তাৎক্ষণিকভাবে এই আচরণের প্রতিবাদ করি।’
এই শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ওই ঘটনা নিয়ে তিনি যখন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন, তখন থেকে তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা শুরু হয়। তার ভাষায়, ‘অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে বিভাগের চেয়ারম্যান জুনায়েদ আহমেদ হালিম ও শিক্ষক আবু সাহেদ ইমন আমাকে সেটি তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। এতে আমি রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে হাত–পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। আমাকে একঘরে করে দেওয়া হয়। আমাকে বিভিন্ন পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়। অনার্সের ফাইনাল ভাইভায় আমাকে ফেল করানো হয়।’
মিম বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি তারা আমার গ্রামের বাড়িতে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার বাবা–মা অসুস্থ, তাদের ওপর প্রেশার করেছে অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য। অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় আমাকে বিভাগের রুমে কোনো মহিলা শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে দরজা আটকে জোর জবরদস্তি করা করা হয়েছে।’
অভিযোগ করেও কেনো প্রতিকার না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আজীবন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করিনি। কোন সংগঠনের সাথেও আমি জড়িত নই, আমি সাধারণ একজন ছাত্রী। আমি প্রতিবাদ করেছি বলেই আজ অনার্স ফেল। কুপ্রস্তাবে রাজি না হয়ে অন্যায় করেছি বলে এখন আমার মনে হয়। আমি হয়ত অবন্তিকার মত সাহসী না, তাই হয়ত আত্মহত্যা করতে পারিনি। কে জানে এর পর আমি বেঁচে থাকব কি না। কিন্তু মূল্যহীন হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
শিক্ষকদের কী ভাষ্য : মিমের অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ দাবি করে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন গত মঙ্গলবার বলেন, ‘অবন্তিকার মৃত্যুতে তার সহানুভূতিকে পুঁজি করে সে (মিম) গণমাধ্যমের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে।’ মিম অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনও দিয়েছিল। এই শিক্ষক তখন উচ্চ আদালতে যান। তিনি বলেন, ‘এরকম একটা বিষয় আদালতের বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মিম কীভাবে মিডিয়ায় কথা বলতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এ ব্যাপারে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।’
মিমকে ফেল করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন দমিম ক্লাসই করত না। যেখানে ৬০ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারে না, সেখানে মিম পরীক্ষা দিয়েছে। ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তাকে নম্বর দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নাই।’
ডিবি অফিসে মুখোমুখি : বিষয়টি নিয়ে বুধবার ডিবি কার্যালয়ে ওই ছাত্রী এবং দুই শিক্ষককে ডাকা হয়। মিমের সঙ্গে ছিলেন তার বাবাও। তাদের বক্তব্য শোনেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিম আমাদের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি যেন স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পরেন, কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। আমরা তাকে সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছি। দুই শিক্ষক আমাদের বলেছেন, তারা মিমকে কখনো হুমকি দেননি, আগামীতেও দেবে না এবং চলাফেরায় কোন বাধা দেবেন না।’
যদি মিম স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধার সম্মুখীন হন, কেউ তাকে সমস্যা করছে বলে জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ : এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, স্নাতক ২০১৭–১৮ শিক্ষাবর্ষের যে সসব শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন, তাদের সম্পূরক পরীক্ষা নেওয়া হবে। কোন শিক্ষার্থী কয়টি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছেন, সেই তথ্য জানিয়ে আগামী ২৩ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে তাদের সম্পূরক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিভাগে আবেদন করতে বলা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। এর মধ্য দিয়ে ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিমেরও পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হল। তবে তাকে সুযোগ দিতেই ওই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে– এটা বলতে রাজি নন বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম।