চলতি মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে আশানুরূপ ইলিশের দেখা নেই। গত এক মাস ধরে এ পরিস্থিতি হয়ে পড়েছে আরো নাজুক। জেলেরা ইলিশ ধরার জন্য ৮/১০ দিনের রসদ নিয়ে সাগরে গেলেও অধিকাংশ ট্রলারই প্রায় খালি হাতেই ফিরছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমানে কক্সবাজারের এক তৃতীয়াংশ ট্রলারই সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে বলে জানিয়েছে ট্রলার মালিক সমিতি।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ জানান, কক্সবাজারে ছোট বড় ৭ সহস্রাধিক যান্ত্রিক বোট রয়েছে। এরমধ্যে বড় নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জন এবং ছোট নৌকায় ৫ থেকে ১৭ জন জেলে থাকে। আবার কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগর ঘাটের ইঞ্জিনবিহীন ককশিটের বোটে থাকে মাত্র ২ জন জেলে। ট্রলারগুলোর মধ্যে ইলিশ জালের বোটগুলো ৮/১০ দিনের রসদ নিয়ে এবং তাইল্যা জালের বোটগুলো এক সপ্তাহের রসদ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। আবার ৭/৮ আঙুলের ফাঁসযুক্ত ফইল্যা জালের বোটগুলো সাগরে মাছ ধরতে যায় ৫/৬ দিনের রসদ নিয়ে। এই বোটগুলো রূপচান্দা জাতীয় মাছ ধরে। এছাড়া চাউপ্পা জাল, ডোবা জাল, চামিলা জাল ও চোখফোলা জালের বোটগুলো মাত্র একদিনের রসদ নিয়ে সাগরে যায় এবং মাছ ধরে দিনে দিনেই ফিরে আসে। এই ধরনের জালের বোটগুলো সাগর উপকূলে ছোট প্রজাতির মাছ ধরে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাঁচকাড়া’ (পাঁচ প্রকারের) মাছ বলা হয়। বোটগুলোতে একেক মৌসুমে একেক প্রজাতির মাছ বেশি ধরা পড়ে। তবে কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়া মাছের ৬০ ভাগই ইলিশ।
তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়েনি। যেগুলো ধরা পড়েছে, সেগুলোও আকারে খুব ছোট। ফলে কক্সবাজারের একেকজন ট্রলার মালিক এখন কোটি টাকার ঋণ বহন করছে। অনেক ট্রলার মালিক লোকসান সহ্য করতে না পেরে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করেছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ট্রলারই সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখে। বর্তমানে ট্রলারগুলো শহরের কস্তুরাঘাটস্থ পোতাশ্রয়ে নোঙর করে রাখা হয়েছে।
জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এরমধ্যে ইলিশ ধরা হয় ৪ থেকে ৫ আঙুলের ফাঁসযুক্ত সুতার জাল দিয়ে, যেটি ভাসা জাল নামেই জেলেদের কাছে পরিচিত। আর সাগর থেকে তাইল্যা ও কোরাল মাছ ধরা হয় ২ থেকে ৩ আঙুলের ফাঁসযুক্ত এক ধরনের রক জাল দিয়ে, যেটি তাইল্যা জাল নামেই পরিচিত। কিন্তু চলতি মৌসুমে ভাসা জালে আশানুরূপ ইলিশ ধরা না পড়ায় অধিকাংশ জেলে তাইল্যা জালের দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু তাইল্যা জালেও এখন আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়ছে না। ফলে অনেক ট্রলার মালিক মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। এরফলে প্রায় ৩০ হাজার জেলে–শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। আগামী ঈদ তাদের কীভাবে কাটবে, এনিয়ে অনেকেই চিন্তিত।
কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাট। বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে প্রতিদিন এখানে অসংখ্য ট্রলার আসে। এখান থেকে ইলিশসহ অন্যান্য মাছগুলো ট্রাকবোঝাই করে পাঠানো হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। গতকাল রবিবারও এখান থেকে মাত্র একটি ট্রাকে প্রায় ৫ মেট্রিক টন ইলিশ ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশ ইলিশই তাইল্যা জালে ধরা পড়া বলে জানান ফিশারীঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী।
তিনি বলেন, সাগর থেকে গত এক মাস ধরে দৈনিক গড়ে ২/৩ টনের বেশি ইলিশ আসছে না। অথচ অন্যান্য বছর খুব খারাপ সময়েও দৈনিক ৭/৮ টনের কম ইলিশ আসেনি।
বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী ও কক্সবাজারের সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা ম. কবির আহমদ বলেন, ইলিশ একটি উচ্চ পরিযায়ী (মাইগ্রেটরি) প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। খাদ্য ও উপযুক্ত পরিবেশের কারণে তারা সাগরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে।
তিনি বলেন, কক্সবাজার উপকূলে ইলিশ ধরা না পড়লেও বঙ্গোপসাগরের অন্য উপকূলে বেশি ইলিশ ধরা পড়তে পারে।