ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে যে কোন পণ্য ও সেবার বাজার দাম নির্ধারিত হবে উক্ত পণ্যের সামগ্রিক চাহিদা ও সামগ্রিক জোগানের ভিত্তিতে। এখানে সামগ্রিক চাহিদা ও জোগান বলতে মোট চাহিদা ও জোগানকে বুঝানো হয়। অবশ্য অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন– ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা, নিও ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা এবং আধুনিক অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনমানসিকতা, ভাবনা এবং পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে। ফলে সামগ্রিক চাহিদা ও জোগানের বিশাল পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্বেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারারও পরিবর্তন আসে।
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা যে কোন পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে তত্ত্ব প্রদান করেন তাতে দেখা যায়, কোন পণ্যের চাহিদার সাথে দামের বিপরীত সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে কোন পণ্য বা সেবার দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে উক্ত পণ্য বা সেবার মোট চাহিদার পরিমাণ কমে যায়। বিপরীতভাবে দাম হ্রাস পেলে পণ্য বা সেবার মোট চাহিদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ দাম ও চাহিদার সাথে বিপরীত সম্পর্ক বিদ্যমান। এ বিপরীত সম্পর্কের কারণে চাহিদা রেখা নিম্নগামী হয়। আবার কোন পণ্যের জোগান দেয় উৎপাদনকারীরা। তাই নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যদি কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় তবে ঐ সময়ে উক্ত পণ্যের জোগানও বৃদ্ধি পায়। বিপরীতভাবে পণ্য ও সেবার দাম হ্রাস পেলে জোগানও হ্রাস পায়। অর্থাৎ দামের সাথে জোগানের সম্পর্ক ধণাত্মক। ইহার অর্থ হলো যে, দাম বাড়লে জোগান বাড়ে। আর দাম কমলে জোগান কমে। অতএব দাম ও জোগানের সাথে সম্পর্ক ধণাত্মক বলে জোগান রেখা ঊর্ধ্বগামী হয়। কাজেই একটি পণ্য বা সেবার নিম্নগামী চাহিদা রেখা, ঊর্ধ্বগামী জোগান রেখাকে যে বিন্দুতে ছেদ করে, সেই বিন্দুতে পণ্যও সেবার দাম ও পরিমাণ নির্ধারিত হয়। একে ভারসাম্য দামও বলা হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ‘নির্র্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত’ একটি শর্ত বলা হয়েছে। অর্থাৎ যে সময়ের পণ্য মূল্য নির্ধারণ করা হবে সেই সময়ের কোন অস্বাভাবিক অবস্থা হতে পারবে না। যেমন– ঐ সময়ে যদি দেশের মধ্যে বন্যা দেখা দেয়, অথবা অতি খড়া দেখা দেয়, অথবা কোন রোগ মহামারি আকারে দেখা দেয় (যেমন– করোনা) তবে এভাবে দাম নির্ধারিত হবে না। এ কারণে অর্থনীতির সব তত্ত্ব যথাযথ প্রয়োগ হবে যদি উপরে উল্লেখিত শর্তটি বলবৎ থাকে। এভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে মতামত প্রদান করেন ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষের চিন্তাধারার প্রসার ঘটেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে নতুন নতুন পণ্য যেমন আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনি কলা কৌশলেরও পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে ক্লাসিক্যাল তত্ত্বকে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে পুরোপুরি প্রয়োগ করা যায় না। দামের সাথে চাহিদার যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কিন্তু সকল পণ্যের ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। যেমন– লবণের ক্ষেত্রে দাম ও চাহিদার সম্পর্ক পুরোপুরি কার্যকর নয়। লবণের দাম হ্রাস পেলে বা কমে গেলে কোন গৃহিণী খুশী হয়ে তরকারিতে বেশি লবণ দেয় না। আবার লবণের দাম বেড়ে গেলে কোন গৃহিণী রাগ করে লবণ ছাড়া তরকারি রান্না করে না। কাজেই লবণের দাম হ্রাস বা বৃদ্ধি পেলেও লবণের চাহিদা প্রায় একই থাকে। অর্থাৎ বাস্তবতার নিরিখে অর্থনীতির সকল তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্বে যখন মহামন্দা দেখা দেয় তখন ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ মহামন্দা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য বৃটেনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ লর্ড জে.এম. কেইনস–এর সহায়তা নেয়া হয়। পরবর্তীতে কেইনস এর চিন্তাধারাকে প্রয়োগ করে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি মহামন্দা থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। কেইনস এর চিন্তাধারা ছিল ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের তুলনায় ভিন্ন। কেইনস– এর এই মতবাদকে নিও ক্লাসিক্যাল চিন্তাধারা বলা হয়। এখানে মহামন্দা একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থনীতিতে তথা সমগ্র বিশ্বে যখন পণ্য বা সেবার দাম ক্রমাগত হ্রাস পায় তখন অর্থনীতির এ অবস্থাকে বলা হয় মন্দাভাব বা মহামন্দা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী তথা বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য মহামন্দার কারণে যদি হ্রাস পায় তবে তো ভাল কথা না। কারণ পণ্যের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পেলে উৎপাদনকারীর লোকসান হয়। ফলে পরবর্তীতে উৎপাদনকারীরা উৎপাদন কমিয়ে দেবে। উৎপাদন কমিয়ে দিলে উৎপাদনকারীরা শ্রমিক ছাটাই শুরু করে। এ কারণে সমগ্র অর্থনীতিতে পণ্যের মোট চাহিদা হ্রাস পায়। বাজারে তখন অবিক্রিত পণ্য থেকে যায়। ফলে উৎপাদনকারীরা আরো উৎপাদন কমায় এবং আরো শ্রমিক ছাটাই করে, এভাবে অর্থনীতিতে বেকার সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। সমগ্র অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। এজন্য বলা হয়ে থাকে অর্থনীতিতে মহামন্দার (মূল্য সংকোচন) তুলনায় মূল্যস্ফীতি অধিকতর ভালো।
বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? অর্থনীতিতে তত্ত্ব যখন প্রয়োগ করা হয় তখন অনুমান হিসেবে মুক্ত অর্থনীতিকে (কর আরোপ বা অন্য বাধা আরোপ করা না হওয়া) গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ দেশের সরকার মুক্ত অর্থনীতিকে গ্রহণ করে না। সরকার নিজদের সুবিধার জন্য বা অধিক আয় করার জন্য প্রতিটি আমদানি পণ্যের ওপর এবং কোনো কোনো সময় দেশে উৎপাদিত পণ্যের ওপর কর আরোপ করে। এতে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকার যদি স্বল্প করারোপ করে তবে তাতে পণ্যে মূল্যের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। সরকারের উচ্চ মহল তা মানে না। যেমন– এক তথ্যে দেখা গেছে বিদেশ থেকে এক কেজি খেজুর আমদানি করলে তাতে খরচ পড়ে ১১০ টাকা বা তার চেয়ে কিচু বেশি। কিন্তু সরকার এক কেজি খেজুরের ওপর করারোপ করে ১৪০ টাকা। ফলে বাংলাদেশে খেজুরের মূল্য বৃদ্ধি পাবেই। আবার প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে ৪৩ টাকা শুল্ক ও কর যোগ করে এবং অতি মুনাফা অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশে চিনির দাম নির্ধারিত হয়। ফলে চিনির দাম বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজি। স্থল বন্দর বা সমুদ্র বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে বাজারে আনার সময় রয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে মালামাল আসলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই সব মালামাল পৌঁছে দিতে সড়ক বা মহাসড়ক দিয়ে যেতে হয়। আর এসব সড়কে রয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। মালামাল পরিবহনের সময় চাঁদাবাজদের প্রদেয় অর্থ পণ্যের মূল্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে পণ্যের দাম বাড়ে। এসব চাঁদাবাজির খবর প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় আসে। কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উচ্চ মহল থেকে শোনা যায়, চাঁদাবাজদের ছাড় দেয়া হবে না। তারপরও তা নীরবে চলে।
এরপরে রয়েছে সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন থেকে বলা হচ্ছে মজুতদারদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। শাস্তিও কিছু কিছু হচ্ছে। তারপরও দমছে না। মজুতদারেরা পণ্য মজুত করে এবং পরস্পরের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্যকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার ভেতর রয়েছে ডলার সংকট। সরকার নির্ধারিত ১১০ টাকা মূল্যে ডলার পাওয়া যায় না। আমদানিকারকদের ১২৩ টাকা বা এর অধিক মূল্যে ডলার কিনতে হয়। ফলে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য ক্রমাগত বাড়ে। সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, উচ্চ শুল্ক বা কর, ডলার সংকট– এ বিষয়গুলো অর্থনীতির তত্ত্বে আলোচনা করা হয় না। যদিও কিছুটা শুল্ক বা কর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি, ডলার সংকট ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি